যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ তছনছ করে দিচ্ছে রাশিয়ার একটি বোমা। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা এই বোমা যুদ্ধে রাশিয়াকে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এই বোমাটি আসলে সোভিয়েত আমলের।
নতুন প্রযুক্তির মিশেলে এটি এখন দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এটি এতই শক্তিশালী যে আঘাত হানার পর মাটিতে ১৫ মিটার চওড়া গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে।
বোমাটির নাম এফএবি–১৫০০। এর ওজন দেড় টন। এই ওজনের প্রায় অর্ধেকই শক্তিশালী বিস্ফোরক। বোমাটি যুদ্ধবিমানে বহন করে ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে ছোড়া হয়। এই দূরত্ব ইউক্রেনের অনেক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার আওতার বাইরে। কোনও এলাকা দখলের চেষ্টার আগে সেখানে এফএবি-১৫০০-এর ব্যবহার করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে রাশিয়া।
সম্প্রতি ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলে ধারণ করা একাধিক ভিডিওতে রাশিয়ার নতুন এ বোমার ব্যাপক শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলে ইউক্রেনের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, কারখানা ও বহুতল ভবনে বোমাটি দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য এসব স্থাপনা ব্যবহার করত ইউক্রেনের বাহিনী।
এফএবি-১৫০০ বোমায় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে সেটি কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত বোমাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য সেটিতে ডানাও যুক্ত করা হয়েছে।
যুদ্ধ–সংঘাত নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা ওয়েবসাইট ‘দ্য ওয়্যার জোন’–এ বলা হয়েছে, রাশিয়ার বৈমানিকরা শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেই বোমাটি ছুড়তে পারছেন।
দোনেৎস্কের ক্রাসনোহোরিভকা শহরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইউক্রেনের একজন সেনা গত সপ্তাহে সিএনএনকে বলেন, ‘আগে আমাদের ওপর শুধু কামানের গোলা দিয়ে হামলা চালানো হতো। এখন রুশ বাহিনী ক্রাসনোহোরিভকা শহরে আরও আগ্রাসীভাবে হামলা চালাচ্ছে। তারা বিমানবাহিনীর নানা অস্ত্র ব্যবহার করছে, বিশেষ করে এফএবি–১৫০০।’
ইউক্রেনের ওই সেনা বলেন, ‘তারা কেন এফএবি-১৫০০ ব্যবহার করছে? কারণ, এই বোমার ক্ষয়ক্ষতি হয় গুরুতর। আপনি যদি এর কবল থেকে বেঁচেও যান, তবে নিশ্চিতভাবে গুরুতর আহত হবেন। এটা আমাদের সেনাসদস্যদের মনোবলের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে। যদিও তারা এই বোমা হামলার ঝুঁকির সঙ্গে নিজেদের অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন, তারপরও এটা নরকের মতো।’
দোনেৎস্ক অঞ্চলে রুশ বাহিনীর হামলার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ হয়ে উঠেছে এফএবি-১৫০০ বোমা। গত ফেব্রুয়ারিতে এ অঞ্চলের আভদিভকা শহর দখল করেন রুশ সেনারা। এই শহরে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিতে বোমাটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইহনাতের ভাষায়, ‘আভদিভকায় লড়াইয়ের আগমুহূর্তে ও লড়াইয়ের সময় কয়েক দিনের মধ্যে রুশ বাহিনী আকাশ থেকে শত শত বোমা ফেলেছিল। এর মধ্যে ৪৮ ঘণ্টায় শহরটির দিকে ২৫০টি বোমা ছোড়া হয়েছিল।’
সোভিয়েত আমলের এফএবি–১৫০০ বোমায় পরিবর্তন এনে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে মস্কোর কাছের একটি কারখানায়। কম খরচে বোমাগুলো অনেকটা ক্ষেপণাস্ত্রে রূপ নিচ্ছে।
এ নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইডেট সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক জাস্টিন ব্রংক বলেন, ‘এই বোমা নতুন করে তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু, রাশিয়ার হাতে সোভিয়েত আমলের পুরোনো বোমার বড় ভাণ্ডার রয়েছে।’
এফএবি-১৫০০ বোমা প্রতিহত করতে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন দেশটির বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইহনাত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। তবে এখনো আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। রুশ বাহিনী বোমাটি ব্যবহার করে শুধু আমাদের সম্মুখসারির অবস্থানে আঘাত হানছে না, এর পেছনের সামরিক স্থাপনাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করছে।’
ইউরি ইহনাতের ভাষ্যমতে, রাশিয়ার সুখোই–৩৫ ও সুখোই–৩৪ যুদ্ধবিমান থেকে বোমাগুলো ছোড়া হচ্ছে। আঘাত হানার জন্য সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তুর কাছেও আসতে হচ্ছে না। যদি ইউক্রেনের হাতে আরও দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকত, তাহলে যুদ্ধের সম্মুখসারির কাছে আসার আগেই যুদ্ধবিমানগুলোকে ধ্বংস করা যেত।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়ার বিমানবাহিনীর ভূমিকা অনেকটা সীমিত ছিল। তবে এফএবি-১৫০০ বোমার কারণে তারা এখন অনেক তৎপর হয়েছে বলে মনে করেন গবেষক জাস্টিন ব্রংক।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের হাতে থাকা প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থারই কেবল এসব বোমা ঠেকানোর সক্ষমতা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুবই কমসংখ্যক রয়েছে ইউক্রেনের হাতে।
এদিকে মার্কিন কংগ্রেসের বাধার কারণে ইউক্রেনকে নতুন করে সামরিক সহায়তা দিতে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে কিয়েভের হাতে প্যাট্রিয়ট ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতও কমে এসেছে।