গুজরাটের ভাদনগরে দরিদ্র পরিবারে জন্ম এক বিস্ময় বালকের। বয়স বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই বালকের আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি এগিয়ে ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কৈশোরকালেই করেছেন গৃহত্যাগ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হলেন মহানায়ক রূপে। নিজের নামের স্থান দিলেন তার দেশেরই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নামের পাশে। এই বিস্ময় বালক আর কেউ নন, ২০১৪ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আত্মবিশ্বাস, আবেগ, ভালোবাসা ও কঠোর পরিশ্রমের অনন্য সমন্বয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠে একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। আর এই সকল গুণের অধিকারী যেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তিনি জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন রাজনীতির মঞ্চে। আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর এই ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতেও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আবার নানা সময়ে নানা বিতর্কের উত্থান ঘটলেও বেশ সাবলীলভাবেই বিতর্কের তীর ঘুরিয়ে দিয়েছেন সমালোচকদের প্রতি।
কৈশোরেই যে বালক স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যান, তাকে আর ঘরে আবদ্ধ করে রাখে কে? বয়স যখন মাত্র ৮, তখনই বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দের কাছে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস) পেয়ে যান লক্ষ্মণ রাওকে, যাকে তিনি রাজনৈতিক গুরু হিসেবেই মানেন।
একদিকে রাজনৈতিক গুরু, অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। তাই স্বল্পকালের জন্য মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পরিব্রাজক হয়ে গৃহত্যাগ করেন মোদি। রাজকোট শহরের রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুর মাঠ হয়ে আলমোড়া শহরে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে যোগ দেন। তবে আশ্রমে বেশিদিন থাকেননি। মাত্র দুই বছর পর আবারও আহমেদাবাদে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
বাড়ি ফিরে পুনরায় আসা যাওয়া শুরু করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে। জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালে আরএসএস এর সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হন। যোগদানের পরপরই সংঘটির অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেন। তবে তার কিছুদিন পরই ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিষিদ্ধ করে এ-র সদস্যদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। ইন্দিরা গান্ধীর গ্রেফতার অভিযান চলমান থাকা অবস্থায়ও বিভিন্ন ছদ্মবেশে সরকারবিরোধী প্রচার পুস্তিকা বিতরণ ও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন নরেন্দ্র মোদি। জরুরিকালীন অবস্থা বিরোধী আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিতে গুজরাটের লোকসংঘ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন। এর সুবাদে গুজরাটের বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের সমন্বয় করার সুবর্ণ সুযোগ আর হাতছাড়া করেননি তিনি।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মাধ্যমেই ১৯৮৫ সালে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) আসা হয় নরেন্দ্র মোদির। যোগদানের মাত্র তিন বছরের মধ্যে গুজরাট শাখার কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৮ সালে সংগঠনের কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির উল্লেখযোগ্য নেতা কেশুভাই প্যাটেল এর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি অভিযোগ উঠার পর গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী পদে তার বিকল্প হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আসা হয়। এই উত্থানের পর আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মাথায় গুজরাটে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এই ঘটনায় ভারত সরকারের তথ্যমতে ১ হাজার ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭৯০ জনই ছিলেন মুসলমান। গুজরাটের এই দাঙ্গায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদির কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না থাকায় অনেকেই মোদিকে দায়ী করে থাকেন। তবে তা ‘দায়ী’ না কি ‘দায়ী নয়’ এর বাহিরে এসে যে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে তা হলো মোদির জনপ্রিয়তা। কেননা এরপর আরও তিন মেয়াদে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিই নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজ্যভিত্তিক রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিকে পদার্পণ করেন ২০১৩ সালে। এখানেও ছিল তার বাজিমাত। টানা চার মেয়াদে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সুবাদে ২০১৩ সালে বিজেপি থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ও তুমুল জনপ্রিয়তার কল্যাণে জয়লাভও করেন। নির্বাচনের পর ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, কূটনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত অগ্রসরমাণ। তবে এর আড়ালে নরেন্দ্র মোদির বিতর্কগুলো পিছুই ছাড়ছে না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ও পরে উভয় জীবনেই নানা বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত তিনি।
তার বিতর্কের বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বিবাহিত জীবন। পরিব্রাজক হিসেবে গৃহত্যাগ করার আগে বিয়ে করলেও দাম্পত্য জীবন অন্যান্য সাধারণের মতো নয়। পরিবারের ইচ্ছায় কৈশোরে যশোদাবেনকে বিয়ে করলেও তাকে পুরোপুরি স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। আবার তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদও হয়নি। রাজ্যস্তরের নির্বাচনী হলফনামায় স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেননি। তবে ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় মনোনয়নপত্রে স্ত্রী হিসেবে যশোদাবেনের কথা উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সত্যাগ্রহ করে জেলে গিয়েছিলেন বলে দাবি জানানোর পর আবারও আলোচনায় এসেছেন তিনি। গুজরাট দাঙ্গা বিতর্কের জেরে শুরু হওয়া নিজেকে আরএসএস কর্মী হিসেবে হিন্দুত্ববাদ রক্ষার কার্যক্রম এখনো চলমান। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আইনের সাহায্যে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির বিতর্কে ২০১৯ সালে রামমন্দির স্থাপন করেছেন। একই বছরের শেষদিকে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনের উদ্দেশ্য মুসলিম অভিবাসীদের বাছাই করা। সেই বছর আগস্টে হালনাগাদকৃত তথ্যে ১৯ লাখ বাসিন্দার নাম ছিল না। আর এই আইন সংশোধনের ফলে তারা নাগরিকত্ব হারানোর শঙ্কায় ছিলেন। এর ফলেই শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। যে আন্দোলনে বিজেপি ও আরএসএস -এর কর্মীরা ছাড়া অপরাপর রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও একাত্মতা পোষণ করেছিল। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলন চললেও মোদি সরকার এই সংশোধন বাস্তবায়ন করেছেন। সর্বশেষ গত বছর মনিপুরে হিন্দু-খ্রিস্টান দাঙ্গাতেও ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত এই দাঙ্গায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
এতসকল বিতর্কের মাঝে নরেন্দ্র মোদি যেন আত্মবিশ্বাস আরও বেশি পেয়েছে। কেননা, চলতি বছর নির্বাচনের আগে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ৪০০ আসনে জয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কংগ্রেসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ফলাফল শেষে অবশেষে জোট সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন সেই বিস্ময় বালক।