ভারতের লোকসভা নির্বাচনে এবং জাতীয় সংসদে মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে বলে জানা গেছে। বুধবার (১২ জুন) ভয়েস অব আমেরিকার একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ২৭ জন মুসলিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ২০২৪ সালে নির্বাচিত হয়েছেন ২৪ জন অর্থাৎ গত ২০১৯ সালের নির্বাচন থেকে ৩ জন কম।
২০১৯ সালে যত মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছিল ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তার থেকে ৪১ জন কম মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
ভারতে এবারের লোকসভায় সংসদে অংশ নেবেন ২৪ জন মুসলিম সংসদ সদস্য। এর মধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের জন্য নির্ধারিত বেঞ্চে ৭ জন বসবেন। এরপরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল থেকে নির্বাচিত ৫ সংসদ সদস্য।
উত্তরপ্রদেশের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন ৪ জন মুসলিম প্রার্থী। কেরালার ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ থেকে ৩ জন এবং কাশ্মিরের ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে ২ জন, হায়দ্রাবাদের অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সংখ্যা ১ জন এবং নির্দলীয় ২ জন। এছাড়া জাতীয় কংগ্রেস দল থেকে ১ জন সংসদে অংশ নেবেন।
জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ, লোকসভার ৪.৪২
ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)-র ২শ ৯৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে মুসলিম, খ্রিস্টান বা শিখ সমাজের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংসদ সদস্য একজনও নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে বিজেপির এক বৌদ্ধ প্রার্থী এবারেও বিজয়ী হয়েছেন।
বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে লোকসভায় কখনোই মুসলিম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৫ শতাংশের বেশি হয়নি।
ভারতে মুসলিম জনপ্রতিনিধি ১৯৫৭ এবং ১৯৯৯ সাল ছাড়া প্রতিবারই ছিল ৫ শতাংশের ওপরে। সর্বোচ্চ মুসলমান জনপ্রতিনিধি ছিল ১৯৮০ সালে ৯.০৪ শতাংশ এবং ১৯৮৪ সালেও ছিল ৮ শতাংশের ওপরে। এবারে তা নেমে এসেছে ৪.৪২ শতাংশে, যা ২০১৯-এর থেকেও বেশখানিকটা কম।
ভারতে ২০১১ সালের শেষ জনশুমারি অনুসারে দেশে মুসলিম জনসংখ্যা ১৪.২ শতাংশ অর্থাৎ ১শ ৭২ কোটি। ভারতে অতীতেও এই হারের ধারে কাছেও যায়নি লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব। সেইসঙ্গে ২০১৪ সালের পর থেকে তো আরো দ্রুত কমছে।
মুসলিম প্রার্থী মনোনয়ন পাচ্ছেন না
মুসলিম সংসদ সদস্যের সংখ্যা ২৭ থেকে কমে ২৪ জনে এসে দাঁড়ালেও ২০২৪-এর নির্বাচনে সব দলই কমসংখ্যক মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। অতীতে কখনোই এত কমসংখ্যক মুসলিম প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
১০ বছর আগে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সব দল মিলিয়ে ৩শ ২০ জন মুসলিম প্রার্থী ছিলেন, যা ২০১৯-এ নেমে আসে ১শ ১৫ জনে। এবারে তা কমে হয়েছে ৭৮ জনে অর্থাৎ প্রতি নির্বাচনে ভারতে মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা দ্রুত হারে কমছে।
সম্ভবত তার চেয়েও লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্র সরকারে কোনো মুসলমান মন্ত্রী নেই। এটা ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও হয়নি। ১০ বছর আগে লোকসভায় মুসলমান সংসদ সদস্যের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম, মাত্র ২৩ অর্থাৎ এবারের চেয়েও একজন কম। কিন্তু সে সময়েও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন নাজমা হেপতুল্লা।
বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩শয়ের বেশি আসন পায় কিন্তু তখনও একজন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তার নাম মুখতার আব্বাস নাকভি। এর অর্থ দাঁড়ায় ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ভারতের রাজনীতি ক্রমশ ‘বহুত্ববাদী চরিত্র’ হারিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে আগাচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী দলের শক্তি যাই হোক, বিজেপিবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এখন আরো কমসংখ্যক মুসলিম প্রার্থী দিচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, প্রধান বিরোধী দলগুলি, যারা নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে দাবি করে, তাদের মধ্যে কংগ্রেস ২০১৯ সালে ৩৪ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছিল। এবারে দিয়েছে মাত্র ১৯ জন। যদিও তখন তারা জিতেছিলেন ৪টি আসনে। এবারে কমসংখ্যক মুসলিম প্রার্থী দিয়ে জিতেছেন ৭টি আসনে।
তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিল ১৩ জন। এবার সেখানে দিয়েছে ৬ জন। সমাজবাদী পার্টি দিয়েছিল ৮ জন। এবার তারা দিয়েছে মাত্র ৪ জন। বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল দিয়েছিল ৫ জনকে এবং ২০২৪ সালে মনোনয়ন দিয়েছে ২ জন মুসলিম প্রার্থীকে। অর্থাৎ বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিতেও মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
মুসলিম প্রার্থী কম দিলেও বেশি জিতলেন কেন
২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কম প্রার্থী দিলেও শতাংশের হারে মুসলিম প্রার্থী জিতেছেন বেশি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে কলকাতার প্রতীচী ইনস্টিটিউটের জাতীয় গবেষণা সমন্বয়ক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক সাবির আহমেদ বলেন, গত ১০ বছরের ‘ট্রেন্ড’ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বিজেপির আসন যত বাড়ছে, মুসলিম প্রতিনিধিত্ব লোকসভায় তত কমছে।
এবার এনডিএ এবং প্রধানত বিজেপির আসন হ্রাস পাওয়ার ফলে, মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিরোধীরা আগের থেকে প্রার্থী অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল এবার। ফলে, একটা চিন্তার জায়গা তৈরি হয় যে, শেষপর্যন্ত কতজন মুসলিম প্রার্থী লোকসভায় যেতে পারবেন।
এবার বিরোধীরা যদি ২০১৯ সালের বা অতীতের মতো মুসলিম প্রার্থী দিতেন তবে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল বলে মনে হয়।
কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মোহাম্মদ রিয়াজও মনে করেন, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার কারণেই লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব আরো কমে গেছে।
আগামী দিনের ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে এটি কী ইঙ্গিত দেয়, এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, ভারতের রাজ্য বিধানসভা বা লোকসভায় মুসলিমদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব কখনোই ছিল না। এর পরে আবার জোরালো হিন্দুত্ববাদী হওয়ার জেরে তারা আরও প্রান্তিক হয়েছেন বা বলা যায় লোকসভা থেকে কার্যত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।
এর প্রধান কারণ হিসেবে বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে দায়ী করেন তিনি।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ধরেই নিয়েছে যে, মুসলিম ভোট তারাই পাবে, এই ধরে নেওয়ার রাজনীতি মুসলিম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ক্রমাগত কমাচ্ছে। যে সব আসনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, সেখানে তাদের জেতার সম্ভাবনাও ক্রমেই কমছে।
এটাকেই হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা, যখন বিজেপি আসন কম পেলেও পরাজয়ের আশঙ্কায় ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে।