যুক্তরাজ্যের এবারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে স্যার কিয়ের স্টারমার-এর নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। ১৪ বছর পরের এ ভুমিধস জয়ের মাধ্যমে লেবার পার্টি ফের যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরছে। আইনজীবী থেকে রাজনীতি, সেখান থেকেই এবার জয়ের মুকুট পরতে চলেছেন কিয়ের স্টারমার।
রাজনীতিতে আসার আগে স্টারমার আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য এক কর্মজীবন অতিক্রম করেন। তবে রাজনীতি নিয়ে তার বরাবরই আগ্রহ ছিল। তরুণ অবস্থায় তিনি ছিলেন উগ্র বামপন্থী।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, চার বছর আগে কট্টর বামপন্থী রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের জায়গায় লেবার পার্টির নেতৃত্বে আসেন স্যার কিয়ের স্টারমার। তখন থেকেই রাজনীতির ময়দানের কেন্দ্রে দলকে ফেরানোর লক্ষ্যে এবং ভোটে ভাল ফল করার জন্য কাজ শুরু করেন তিনি।
ভোটের আগে তিনি এক শব্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার করেছেন। তা হচ্ছে ‘পরিবর্তন’। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরও স্টারমারকে ডাউনিং স্ট্রিটে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।
সমর্থকদের চোখে স্টারমার একজন বাস্তববাদী মানুষ। তবে সমালোচকদের কাছে স্টারমার চৌকস নন। বরং তিনি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়া একজন রাজনীতিক। এ প্রসঙ্গে স্টারমারের জীবনী লেখা সাংবাদিক টম বাল্ডউইন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, তিনি হয়তো বড় বড় বক্তব্য দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন না। তিনি যা করতে পারবেন তা হলো সমস্যাগুলো ঠিক করতে পারবেন।
১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা এই নেতা পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে একজন। কিয়ের স্টারমার দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের সারেতে বেড়ে ওঠেন।শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে জীবনের নানা যোগের কথা প্রায়শই বলতে শোনা যায় স্যার স্টারমারকে।
রাজা চার্লসের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তবে স্টারমারের উঠে আসা শ্রমজীবী পরিবার থেকে। নির্বাচনী প্রচারের সময় স্টারমার বলেছিলেন, ‘আমার মা ছিলেন একজন নার্স, আমার বাবা ছিলেন একজন মিস্ত্রি।’
তিনি আরও বলেন, তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে। লেবার পার্টির প্রথম নেতা কিয়ের হার্ডির নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল।
স্টারমারের বড় হয়ে ওঠার গল্প ও পারিবারিক জীবন খুব সুখকর ছিল না, দূরত্ব রেখে চলতেন তার বাবা। তার মা জীবনের দীর্ঘকাল 'স্টিল'স ডিজিজ' নামক এক ধরনের অটো-ইমিউন ডিজিজে ভুগেছেন। রোগের কারণে ধীরে ধীরে হাঁটার এবং কথা বলার ক্ষমতা হারান তার মা। একসময় তার পা কেটে বাদ দিতে হয়।
তারপর, ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন কিয়ের স্টারমার। কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থী একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেন তিনি।
কিয়ের স্টারমার তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন। লিডস এবং অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ব্যারিস্টার হিসাবে মানবাধিকার নিয়ে কাজও করেছেন। সেই সময় ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির জন্য তিনি কাজ করেন তিনি।
১৯৯০-এর দশকে একটা বিখ্যাত মামলায়, তিনি দু'জন ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশ আন্দোলনকারীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে 'ম্যাকডোনাল্ডস' মামলা করেছিল। পরে ২০০৮ সালে, স্যার কিয়ের পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার অর্থ, তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন এবং ২০১৪ সালে তাকে নাইট উপাধি দেয়া হয়।
স্টারমার প্রথমবার সংসদে যান ২০১৫ সালে। লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কট্টর বাম রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি তখন বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছিল। পরে অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ নজরে রাখার জন্য স্যার কিয়েরকে 'শ্যাডো হোম সেক্রেটারি' (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসাবে নিয়োগ করেন জেরেমি করবিন।
যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়ার পরে, স্টারমারকে 'শ্যাডো ব্রেক্সিট মন্ত্রী' হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর লেবার পার্টির নেতা হওয়ার সুযোগ পান স্যার কিয়ার স্টারমার।
স্টারমার ৫২ বছর বয়সের আগে নির্বাচনী রাজনীতিতে আসেননি। তিনি ২০১৫ সালে লন্ডন ডিস্ট্রিক্ট অব হলবোর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাসের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হন। ব্রেক্সিটের সময় বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেন। স্টারমার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তার দলের অনেক নেতাই এর পক্ষে ছিলেন।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে স্টারমার বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে যেসব মানুষ আসছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না।’
কনজারভেটিভ সরকারের রুয়ান্ডা অভিবাসী প্রত্যাবাসন প্রকল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। পরে সমালোচনার মুখে পড়ে সুর পরিবর্তন করে স্টারমার। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে বোঝাতে চাইনি। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আমাদের দেশের প্রতি বাংলাদেশি কমিউনিটির অবদানকে আমি ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করি।’