বন্ধু রাষ্ট্র ফ্রান্সের ওপর বেজায় খেপেছে ইসরায়েল। এতটাই রাগ করেছে যে ক্ষোভে লেবাননে কর্মরত ফরাসি সংস্থা ‘টোটাল এনার্জি’-র গ্যাস স্টেশন বিমান হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমন এক সময়ে তিনি এই আহ্বান জানান, যখন চলমান গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি লেবাননেও স্থল আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েল।
লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযানের কড়া সমালোচনা করে এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, যুদ্ধের বিস্তৃতি কমিয়ে আনা উচিত। লেবাননের জনগণকে এভাবে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। লেবানন আরেকটি গাজা হতে পারে না।
তবে, গত এক বছর ধরে ইসরায়েলের আক্রমণে গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে যখন আমেরিকা সোচ্চার হয়েছে, তখনও সেভাবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কথা বলেনি ফ্রান্স। কিন্তু লেবাননে আইডিএফের আক্রমণ শুরু হতেই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে সুর চড়াতে শুরু করে প্যারিস। যা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গাজা ও লেবাননে ফরাসিদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণ কী? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভূমধ্যসাগরের তীরের দেশটিতে প্যারিসের আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে। যা কোনও ভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
বস্তুত, বিশ শতকের প্রথম পর্বে লেবানন বলে কোনও দেশের অস্তিত্বই ছিল না। এই এলাকা ছিল সিরিয়ার অন্তর্গত। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড চলে আসে ফ্রান্সের দখলে। যার মধ্যে ছিল আজকের সিরিয়া ও লেবানন।
এর পরেই সিরিয়ার পশ্চিম অংশের খ্রিস্টানবহুল এলাকা নিয়ে আলাদা একটি দেশ তৈরি করে তৎকালীন ফরাসি সরকার। যার শাসন ব্যবস্থা এক রকম নিয়ন্ত্রিত হত প্যারিস থেকেই। জায়গাটি ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী হওয়ায় লেবানন হয়ে ওঠে ফ্রান্সের সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। এখান থেকেই পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে মালপত্র আনা-নেওয়া করে প্যারিস।
১৯১৮ সালে লেবানন তৈরির সময়ে সেখানকার বাসিন্দাদের ৫০ শতাংশ ছিলেন খ্রিস্টান। বাকি ২৫ শতাংশ করে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমরা থাকতেন সেখানে। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। লেবাননের ঠিক নিচে প্যালেস্টাইন ভেঙে জন্ম নেয় ইহুদি দেশ ইসরায়েল। ফলে সেখানকার মুসলিম বাসিন্দারা দলে দলে লেবাননে আসতে শুরু করেন।
লেবাননের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হল ফরাসি। সেখানকার ৭০ শতাংশ স্কুলে তা পড়ানো হয়। ফি বছর বিপুল সংখ্যায় ফ্রান্সবাসী পশ্চিম এশিয়ার এই দেশে বেড়াতে যান। এর জন্য লেবাননজুড়ে একাধিক দূতাবাস খুলেছে প্যারিসের সরকার।
১৯৫১ সালে লেবাননে পা রাখে ফরাসি সংস্থা টোটাল এনার্জি। পরবর্তী সময়ে ভূমধ্যসাগর থেকে তেল উত্তোলনের কাজ শুরু করে এই সংস্থা। ওই এলাকাকে কেন্দ্র করে বৈরুত ও তেল আবিবের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। ফলে বছর দুই আগে ইহুদিদের সঙ্গে সমঝোতা করে টোটাল এনার্জি।
সেই সমঝোতা অনুযায়ী ফরাসি সংস্থার ভূমধ্যসাগর থেকে খনিজ তেল উত্তোলন মেনে নিয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু দু’বছরের মাথাতেই তাদের গ্যাস স্টেশন উড়িয়ে দিল আইডিএফ। লেবাননে টোটাল এনার্জির কর্মী সংখ্যা শতাধিক। ইহুদি ফৌজের হামলায় অবশ্য কারও জীবনহানির খবর আসেনি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, ফ্রান্সের ওপর ইসরায়েলের এই রাগের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ২১ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। যা মানতে পারেননি ইহুদিরা। নেতানিয়াহু সরকারের যুক্তি ছিল, এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাবে হিজবুল্লা। আর তাই বৈরুতে আক্রমণের ঝাঁজ কমায়নি আইডিএফ।
সূত্রের খবর, লেবানন থেকে লগ্নির সিংহভাগ সরিয়ে নিতে ওই যুদ্ধবিরতি চেয়েছিল ফ্রান্স। কিন্তু ইসরায়েল তা মানতে অস্বীকার করায় পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তায় যান এমানুয়েল মাখোঁ। ইহুদি দেশে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
মুখে অবশ্য অন্য কথা বলেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ফ্রান্সের একটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘লেবাননকে কোনও ভাবেই গাজা হতে দিতে পারি না। আর তাই দু’টি দেশের রাজনৈতিক সমঝোতায় ফেরা উচিত বলেই মনে করি।
ফ্রান্সের এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করে ৫ অক্টোবর এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সেখানে সরাসরি নাম করে এমানুয়েল মাখোঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তিনি। বলেন, ‘ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিমা দেশের যে সব রাজনৈতিক নেতা ইসরায়েলের বিপক্ষে কথা বলছেন, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। হামাস ও হিজবুল্লাকে লাগাতার অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে ইরান। ‘শয়তানের পক্ষ’কে এই কাজে আপনারা বাধা দিতে পারছেন না। এটাই সবচেয়ে লজ্জার।
ইসরায়েলের মূল অস্ত্র সরবরাহকারী দেশের তালিকায় অবশ্য অনেক নিচে রয়েছে ফ্রান্সের নাম। ফলে প্যারিস অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলেও হামাস-হিজবুল্লাকে শেষ করার রাস্তা থেকে সরে আসছে না ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
কেউ আমাদের অস্ত্র দিক বা না দিক, এই যুদ্ধ আমরা জিতবই। তখন সারা দুনিয়া আপনাদের দেখে লজ্জায় মাথা নত করবে— সমাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে বলেন নেতানিয়াহু।
এই ঘটনার পর ইসরায়েলের রাগ কমাতে সুর বদলেছে প্যারিস। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে যান ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যাট। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কার্টজের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি।
এদিকে দক্ষিণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়টি (ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, গ্রীস, মাল্টা, সাইপ্রাস, স্লোভেনিয়া, পর্তুগাল ও ক্রোয়েশিয়া) দেশের নেতারা শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ এলাকায় শান্তি আনতে লেবাননের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দক্ষিণ লেবাননে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যাবর্তন এবং সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।