ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতের বিশেষায়িত বাহিনী সিআরপিএফের গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে ফের আলোচনায় পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহম্মদ (জেইএম)। সংগঠনটির নেতৃত্বে আছেন মাসুদ আজহার। পাকিস্তানের মদদে জেইএম এ হামলা করছে বলে ভারত দাবি করলেও তা বরাবরই অস্বীকার করছে পাকিস্তান।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশারফের কিছু বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে ভারতের দাবি সঠিক। পাকিস্তান চাইলেও জেইএমকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি লুকাতে পারছে না। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে জইশ-ই-মুহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহার পাকিন্তানে আছেন বলে স্বীকার করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের বহরে জেইএমের ঐ হামলায় ৪৫ জওয়ান প্রাণ হারান। ঘটনার পর দুই পক্ষই সীমান্তে সৈন্য-সামন্ত জড়ো করে গোলাগুলি করে। এমনকি উভয় পক্ষেরই যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
জেইএমের হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পাঠানো এক চিঠিতে এ নিন্দা জানান।
বর্বরোচিত ঐ হামলার পর দায় স্বীকার করে জেইএমের একাধিক নেতা অডিও ও ভিডিও বার্তায় ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরণের আক্রমণ চলবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। এসব বার্তায় জইশ নেতারা ‘জিহাদ জিন্দাবাদ’, ‘শোদাই কাশ্মীর জিন্দাবাদ’ বলার পাশাপাশি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেও স্লোগান দেন।
অথচ জেইএমের হামলা চালানো এবং তাদের পাকিস্তানে থাকা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী সহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিবিসিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোরেশী বলেন, ‘পুলওয়ামা হামলায় জেইএম জড়িত কি-না আমরা নিশ্চিত নই। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে।’
‘দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কোথায়’ জানতে চাইলে কোরেশী বলেন, ‘জেইএমের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে এবং তারা বলেছে ‘না’। তারা অস্বীকার করেছে। এটাই দ্বিধা।’
কারা যোগাযোগ করেছে জইশ নেতাদের সঙ্গে- জানতে চাইলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যারা তাদের পরিচিত তারা। সেখানে যারা আছে তারা। তারা কোনো দায় স্বীকার করেনি। তারা অস্বীকার করেছে।’
কিন্তু জইশ তো প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে বলা হলে কোরেশী বলেন, ‘এ বিষয়ে পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট আছে। এটাই দ্বিধার।’
আরেকটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোরেশী স্বীকার করে নেন জেইএমের প্রধান মাসুদ আজহার পাকিস্তানেই আছেন।
‘জইশ প্রধান মাসুদ আজহার কি এখন পাকিস্তানে আছেন? যদি থাকেন, তবে কি আপনারা তাকে ধরবেন?’- এমন প্রশ্ন করা হলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি পাকিস্তানেই আছেন, তবে অবস্থা খুব খারাপ। তার অবস্থা এতোই খারাপ যে ঘর থেকেও বেরে হতে পারছেন না।’
কোরেশী পাকিস্তানে জইশ নেতার অবস্থানের কথা বললেও তার ঠিক বিপরীত কথা বলেন দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে জইশ-ই-মুহম্মদের অস্তিত্ব নেই।’ তার এ বক্তব্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয় গত ৬ মার্চ।
মাহমুদ কোরেশী বা মেজর জেনারেল আসিফ গফুরের বক্তব্যে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বক্তব্যে তা বেরিয়ে আসে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে মাসুদ আজহারের নেতৃত্বাধীন জইশ-ই-মুহম্মদকে ভারতের মাটিতে আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেই সাক্ষাৎকারের খবর ৬ মার্চই প্রকাশ হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
সামরিক বাহিনী ও সরকারের বর্তমান নেতৃত্বের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আর সাবেক নেতাদের এমন সরল স্বীকারোক্তি স্বভাবতই চাপে ফেলে দিয়েছে পাকিস্তানকে। সেজন্যই কি-না মাসুদ আজহারের দুই ভাই জেইএম’র নীতিনির্ধারক বলে পরিচিত আবদুল রউফ আজগর ও হামাদ আনসারিকে গ্রেফতার করেছে পাকিস্তান সরকার। যদিও মাসুদ আজহারকে ধরা হয়নি এখনো। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপের মুখে পাকিস্তান মাসুদ আজহারকে না ধরে পার পাবে কি-না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায়।
জইশ-ই-মুহম্মদ ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর তাদের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে ২০০২ সালে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ হলেও সীমান্ত পেরিয়ে এসে একাধিকবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায় জঙ্গি গোষ্ঠীটির সদস্যরা।