হুমায়ুন সমাধি: যেখানে মোগল সাম্রাজ্যের মহিমার যাত্রা শুরু

ভারত, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 20:39:38

নয়াদিল্লির হুমায়ুন সমাধি থেকে: মোগল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর মাত্র চার বছরের রাজত্ব শেষে আফগানিস্তানে ফিরে গেছেন। কাবুলে সম্রাটের মৃত্যু হলে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। অসুস্থ যে পুত্রকে বাঁচাতে সম্রাট বাবর নিজের জীবন তুচ্ছ করেছিলেন, সেই হুমায়ুন বাদশাহ হয়েও বারবার ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। কখনও রাজ্য হারিয়ে কিংবা পাঠাগারের সিড়ি থেকে পড়ে অল্প বয়সে জীবন হারিয়ে।

কিন্তু মৃত্যুর কয়েক বছর পর তার সন্তান সম্রাট আকবর মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধন্য দিয়ে হুমায়ুনের জন্য বিশাল যে সমাধি প্রতিষ্ঠা করেন, সাড়ে ৪০০ বছর ধরে এখনও তা মোগলদের প্রতিষ্ঠার কথা গৌরবের সঙ্গে বলে যাচ্ছে।

এটাই মোগল সাম্রাজ্যের প্রতাপ ও প্রভাব দেখানোর ভিত্তি হয়ে দেখা দেয়। সমাধি সৌধ ছাড়াও এই স্থানটির রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে আটক হওয়ার আগে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Apr/11/1554985028724.jpg

এছাড়া ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময়, পুরান কেল্লা ও হুমায়ুন সমাধি সৌধে আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ শরণার্থী। ভারত থেকে বর্তমান পাকিস্তানের দিকে যাওয়ার জন্য স্থানীয় মুসলমানরা আশ্রয় নিয়েছিল এখানে।

১৫৫৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন এই বাদশাহ। প্রথমে তাঁকে দিল্লির পুরনো কেল্লায় সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর নয় বছর পর ১৫৬৫ সালে তাঁর স্ত্রী হামিদা বানু বেগম প্রিয় স্বামীর স্মৃতিতে যমুনা পারে একটি সমাধি নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ততদিনে আকবর তার সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। নিজাম ভক্ত হুমায়ুনের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল- খাজা নিজামুদ্দিনের দরগার পাশেই তাকে যেন সমাহিত করা হয়। হামিদা বানুর তত্ববধানে সেখানেই এই সমাধি সৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৫৭২ সালে।

সৌধটির নকশা প্রস্তুত করেন পারসিক স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস, যিনি মিরাক গিয়াসুদ্দিন নামেও পরিচিত। তবে নির্মাণকার্য শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র সৈয়দ মুহাম্মদ ইবন মিরাক গিয়াসুদ্দিন পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। বিশাল চারটি দরজা পার হয়ে মূল সমাধি স্থলে যেতে হয়। একজন মানুষের কবরে যেতে এত আয়োজন!

চারপাশটা কয়েক স্তরের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লাল ও সাদা বেলেপাথর দিয়েই তৈরি এ সমাধিক্ষেত্র। এত পরিমাণ লাল বেলে পাথরের ব্যবহার করা এটাই প্রথম স্থাপত্য। সর্বশেষ গেটের পাশে মূল সমাধি ভবন। তার চারপাশে সুন্দর বাগান আর জলাধার। বড় বড় গাছে পাখি যেন ডেকেই যাচ্ছে। চারপাশের ছাদের মাঝে বিশাল গম্বুজ।

সে সময় বিশ্বে এত বড় গম্বুজ ছিল না। এ গম্বুজ ছিল সেসময়ের সবচেয়ে বড় আশ্চর্য স্থাপনা। এর ঠিক মাঝখানেই হুমায়ুনের সমাধি। মূল গম্বুজটিও দোতলা বিশিষ্ট। কবরের চারপাশে আটটি গেট আছে। এই সমাধিকে তাজমহলের পূর্বসূরি বলা যেতে পারে।

যেভাবে মমতাজ মহলের পাশেই সমাহিত শাহজাহান, হুমায়ুনের পাশে সেভাবেই চিরনিদ্রায় শায়িত এই সৌধের নির্মাতা হামিদা বানু বেগম। জাহান্দার শাহ, ফারুক শিয়ার, ও দ্বিতীয় আলমগীরের সমাধিও আছে এখানে। আছে শাহজাহানের কন্যা জাহানারার ও পুত্র দারাশিকের কবরও।

হুমায়ুনের মূল সমাধি সৌধ ছাড়াও পশ্চিমের প্রধান দরজা থেকে সেই সমাধি পর্যন্ত যে পথটি গিয়েছে তার দু’পাশে অনেকগুলো ছোট স্মারক রয়েছে। এগুলো হুমায়ুনের সমাধিরও ২০ বছর আগে নির্মিত। এই সমাধি চত্বরটি সুরি শাসক শের শাহের রাজসভার আফগান অভিজাত পুরুষ ইসা খান নিয়াজির। নিয়াজি মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। ১৫৪৭ সালে এই সমাধি চত্বর নির্মিত হয়।

ব্রিটিশ আমলে সমাধি সৌধের বাগানসহ বিভিন্ন স্থানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ (এএসআই) বিভাগ এই ঐতিহ্য স্মারক সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে মূলভবন এবং বাগান পুনরুদ্ধার করা হয়। আর এ কাজে অর্থ দেয় আগা খান ফাউন্ডেশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর