উদ্বাস্তু বা শরণার্থী বা রিফিউজিদের পক্ষে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ২০ জুন আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস পালন করা হলেও বৈশ্বিক রিফিউজি সমস্যার চিত্রটি মোটেও ভালো নয়। শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে বিলাতের প্রখ্যাত ডেইলি সান পত্রিকা যে সর্বসাম্প্রতিক পরিসংখ্যান হাজির করেছে, তা মারাত্মক, ভয়াবহ ও আশঙ্কাজনক।
'সান'-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমান সময়ে প্রতি এক মিনিটে বিশ্বের নানা স্থানে ২০ জন মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। যুদ্ধ, সহিংসতা ও প্রাণনাশের বিপদ থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে এসব মানুষ উদ্বাস্তু পরিচয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে, যাদের অর্ধেকই শিশু-কিশোর।
উদ্বাস্তুদের ৮৬% ভাগ উন্নয়নশীল দেশের হতভাগা নারী ও পুরুষ। এরা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার সংঘাত কবলিত দেশগুলোর বিপন্ন নাগরিক। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-যুদ্ধ-বিদ্রোহের বিশ্ব তালিকাটিতেও এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলো এগিয়ে। এসব দেশের মানুষই অকাতরে উদ্বাস্তু হচ্ছে।
বিশ্বের মোট শরণার্থীর ৫১% ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। তারা হলো শিশু ও কিশোর। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় যাদের শিক্ষা ও শৈশব ধূলিসাৎ হচ্ছে রক্ত, মৃত্যু, অস্ত্রের তাণ্ডবে।
কেনিয়ার দাদাব শরণার্থী শিবিরকে বলা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু আবাস, যেখানে ৩২৯,০০০ শরণার্থী নারী-পুরুষ-শিশু বসবাস করে। তবে সান পত্রিকার এই সংখ্যাগত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চ্যালেঞ্জ করা যায়, বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ-কুতুপালং রিফিউজি ক্যাম্পকে সামনে রেখে।
মায়ানমারের জাতিগত নিধনের কবল থেকে রক্ষা পেতে যে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তরেখায় বসবাস করছেন, অনেক বিশেষজ্ঞই তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ শরণার্থী গোষ্ঠী বলে মনে করেন। তাদের আশ্রয়স্থলকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রিফিউজি ক্যাম্প বলেও বিশ্বাস করেন তারা।
ডেইলি সান আরও যে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে তা হলো, বিশ্বের আলাদা আলাদা রিফিউজিরা এখন একটি একক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ও জাতিসত্তার পাশাপাশি বিশ্বের রিফিউজিরাও একটি নিজস্ব দল গঠন করে অলিম্পিক ক্রীড়ায় অংশ নিচ্ছে। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো রিফিউজিদের নিয়ে তৈরি টিম অংশ নেয়।
জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা, মানবিক ও ত্রাণ সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক শরণার্থীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। অতীতে আর কখনোই এতো বিপুল শরণার্থী পৃথিবীতে ছিল না।
তবে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষে বিশ্বে শরণার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সত্যিই কঠিন। কারণ, বর্তমানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতি মিনিটে মানুষ গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হচ্ছে। স্রোতের মতো মানুষ ঘরবাড়ি, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে আদিঅন্তহীন শরণার্থীদের মিছিলে। ফলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যাটি সঠিকভাবে হিসাব করে বের করাও বেশ দুরূহ বিষয়।
তথাপি ধারণা করা হয় যে, বিশ্বে বর্তমানে আনুমানিক ৭ কোটি মানুষ স্বদেশ ও স্বগৃহ ছেড়ে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) কর্তৃক প্রতি বছর প্রকাশিত 'গ্লোবাল রিফিউজি ট্রেন্ডস' নামক রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্য, পরিসংখ্যান ও হিসাবগুলো লক্ষ্য করলে শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন স্টাডি রিপোর্ট অনুযায়ী ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, মায়ানমার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিয়েরালিওন প্রভৃতি দেশকে বিশ্বের প্রধান শরণার্থী উৎসস্থল রূপে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ, লেবানন, আজারবাইজানকে গণ্য করা হয় সর্বাধিক সংখ্যক রিফিউজিদের আশ্রয়দাতা দেশ হিসাবে।
আফ্রিকা, এশিয়া, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের মানুষ শরণার্থী হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পশ্চাৎপতা ও অশিক্ষায় জর্জরিত। দুঃখজনক তথ্য হলো, সংঘাত কবলিত ও শরণার্থী সমস্যাগ্রস্ত সিংহভাগ দেশই মুসলিম অধ্যুষিত।
বর্তমান সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা ও সংঘাতকে অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞ-গবেষকরা। রাজনৈতিক-মতাদর্শিক কারণে এবং ধর্মীয়-জাতিগত উগ্রতা ও সম্প্রদায়গত বিরোধের জন্য সৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহ, গণহত্যা ও শারীরিক-মানসিক-যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পরিবার বা আস্ত সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে শরণার্থী হয়ে পালিয়ে রক্ষা পাচ্ছে।
যারা পালাচ্ছে, তারা মানবেতর জীবন-যাপন করে হলেও বেঁচে থাকতে পারছে। কিন্তু খুব সামান্যই স্বদেশের নিজ বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারছে। পৃথিবীতে এমন বহু শরণার্থী শিবির আছে, যেখানে উদ্বাস্তুরা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন। শরণার্থী পরিচয়েই মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ এবং শরণার্থী পরিচয়েই জন্ম নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু।
ফলে বিশ্বের মানবিক সমস্যার মধ্যে এক নম্বর বলে শরণার্থী ইস্যুকে বিবেচনা করা হচ্ছে। শুধু শরণার্থী বা তাদেরকে স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনই নয়, তাদের পরিবার-পরিজন, শিশু-নারী, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, ভরণপোষণ, নিরাপত্তা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জিং এজেন্ডাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আশ্রয়দাতা দেশগুলোর বিভিন্ন বিষয়ও শরণার্থীদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
এসব কারণে শরণার্থী ইস্যু একজন ব্যক্তি বিশেষের সমস্যার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, রাজনৈতিক শান্তি ও সাংস্কৃতিক সহনশীলতা বিষয়ক প্রপঞ্চের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকেও স্পর্শ করছে।
শরণার্থী সমস্যার বহুমাত্রিক অভিমুখের কারণে এবং সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলীকে মোকাবেলার প্রত্যয়ে বিদ্যমান শরণার্থী সমস্যাকে সমন্বিত ভাবে দেখার প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর হচ্ছে। ফলে চলতি ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসের মূল স্লোগান বা প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয়েছে 'Global Compact on Refugees'.
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের কাঁধে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা