থাইল্যান্ডের 'প্রিটি' ইন্ডাস্ট্রির কুৎসিত দিক

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-24 16:51:05

আলোর পেছনে থাকে অন্ধকার। আর এই অন্ধকার দিক রয়েছে সবখানে, সব পেশাতেই। 'প্রিটি ইন্ডাস্ট্রি' থাইল্যান্ডের তরুণীদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি শিল্প। সুন্দরী, আবেদনময়ী কমবয়সী তরুণীরাই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন। এখানে যেমন রয়েছে অর্থ, চাকচিক্য ঠিক তেমনি রয়েছে বঞ্চনা, লাঞ্ছনা এমন কী জীবন হারানোরও শঙ্কা।

ইন্ডাস্ট্রির সেই করুণ দিকটি ফুটে উঠেছে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক স্ট্রেইট টাইমসের রোববারের এক প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ড ভ্রমণে গেলে অনেকেরই চোখে পড়ে যে আবেদনময়ী পোশাক পরনে, নিখুঁত মেকআপ, পরিপাটিভাবে সাজানো চুল ও মুখে স্মিত হাসি নিয়ে অনেক সুন্দরী বিভিন্ন পণ্যের প্রচারণা করছেন। কেউবা রাস্তায় কেউবা কাজ করছেন পাঁচতারকা হোটেলের কোনো মিলনায়তনের সামনে।

নতুন পণ্যের প্রচারণা কিংবা অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বাড়াতে সুন্দরী এইসব নারীকে ভাড়া করেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। এদেরকে বলা হয় প্রমোশনাল মডেল। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে থাইল্যান্ডের 'প্রিটি ইন্ডাস্ট্রি'। যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে স্থানীয়ভাবে তাদেরকে ডাকা হয় 'প্রিটিজ' (রমণীয়) নামে। এদের কারও বয়স বিশের অধিক নয়। পুতুলের মতো দেখতে এসব সুন্দরী দিয়েই চলে পণ্যের প্রচারণা।

বিকাশমান এ শিল্পে থাকা অল্প বয়সী এসব সুন্দরীদের দিয়ে কল্পনাযোগ্য যেকোনো পণ্য প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় কিংবা শপিং সেন্টারে, তারকা হোটেল কিংবা কনভেনশন হলে যেকোনো স্থানেই তারা ক্রেতাদের কাছে পণ্য প্রচারণায় সিদ্ধহস্ত। বিনিময়ে তারা পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ পায়।

তবে এই ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের আশায় ব্যক্তিগত আসরগুলোতে যোগ দিয়ে তাদের আত্মসম্মানকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন। সেই অন্ধকার দিক নিয়ে কথা বলেছেন প্রনপেন কোঙ্গস্রোন নামে এক 'প্রিটিজ'। আর দশটা প্রমোশনাল মডেলদেরেই একজন সে।

একমাস আগে প্রণপেনের সহকর্মী থিতিমা নোরাপহানফিফাট (২৫) খুন হয়। ব্যাংককের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে পড়েছিলো তার মৃতদেহ। ব্যক্তিগত আসরে অতিথিদের পানীয় তুলে দেওয়াসহ মনোরঞ্জনের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল তাকে। ওই হত্যাকাণ্ডে সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

জানা যায়, থিতিমার নিথর মরদেহ টেনে লবিতে নিয়ে আসা হয়। এমনকি ওই আসরে থাকা আরও একজন মডেলকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নগ্ন করা হয়। থিতিমার হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে কতটা বুনো হয়ে উঠতে পারে এসব ব্যক্তিগত আসরগুলো।

থিতিমার সহকর্মী ছিল প্রনপেন। বন্ধু হারানোর বেদনা নিয়ে প্রনপেন বলেন, তারমতো একজন সহকর্মী হারিয়ে খুবই খারাপ লাগছে। সে ছিল সুন্দরী ও খুবই বন্ধুসুলভ।

তিনি আরো বলেন, ‘তার হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে খুবই ঘাবড়ে গেছি। এটা আমাকে আরো সাবধানী করে তুলেছে। কেননা তার মতো আমিও ব্যক্তিগত আসরগুলোতে মাঝেমধ্যে যেতাম।’

বেশি উপার্জনের লোভনীয় সুযোগ প্রনপেনের মতো অনেক সুন্দরী তরুণীকে ‘প্রিটি ইন্ডাস্ট্রির’ দিকে আগ্রহী করে তুলেছে। প্রিটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা যেকোনো তরুণীর বেতন অনেক বেশি। প্রনপেন প্রতিদিন উপার্জন করেন ২ হাজার ৫০০ বাথ যেখানে একজন সাধারণ মানের বিক্রয়কর্মীর আয় আট ভাগ কম।

অনেকে ‘প্রিটিজ’ আছে যারা অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় ব্যক্তিগত আসরে যোগ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। নিজেদের বিকিয়ে দিতেও কেউ কেউ আপত্তি করেন না। আর এটাই এই শিল্পের 'অন্ধকার দিক'।

ইউয়ি নামে একজন সাবেক মডেল বলেন, বর্তমানে প্রিটি ইন্ডাস্ট্রির এই শিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অন্ধকার দিকগুলোই এখন বেশি উঁকি দিচ্ছে এখানে।

তিনি বলেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন ‘প্রিটিজ’ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেসময় নানা ধরনের পণ্য প্রচারণায় যুক্ত ছিলাম। যেমন মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ির প্রচারণা সবকিছুই। অনেক সময় এমন হত যে- আয়োজকদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষ নানা ধরনের প্রস্তাব দিতো। কিন্তু যেকোনো বাহানা করেই এই সব প্রস্তাব তখন ফিরিয়ে দিতে হত।

৩৫ বছর বয়সী ইউই এখন বিমান বালা হিসেবে কর্মরত। ইউইর মতো একই সুরে কথা বললেন ওয়ালাইপান লেরডোয়ারাপাই (৩৫) । এই মধ্যত্রিশেও ওয়ালাইপান প্রিটি মডেল হিসেবে কাজ করছেন। খুব কম মানুষই এত বয়সে এ পেশায় টিকতে পারে। কেননা এখানে কুড়ি বয়সী তরুণীদেরই কদর বেশি।

১৭ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, পণ্য প্রচারণার জন্য যে প্রতিষ্ঠান আমাকে ভাড়া করেছিল তাদেরই একজন নির্বাহী কর্মকর্তা একবার আমাকে শয্যা সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। আমি তাকে সরাসরি অবজ্ঞা করতে শুরু করি, তাই কোনো সমস্যাও তখন হয়নি। এখন তো আমি আরো বেশি অভিজ্ঞ তাই এ ধরনের ব্যাপারগুলো এখন আর সমস্যাও মনে হয় না।

ওয়ালাইপান বলেন, ‘এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি এই শিল্পে টিকে আছি কারণ হলো কাজটা আমি পছন্দ করি। আমি কথা বলতে পছন্দ করি, পরিপাটি করে সেজে মানুষের সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি তখনি খুব খুশি থাকি যখন কাজের মধ্যে থাকি।'

ওয়ালাইপানের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তিনি একটি বাণিজ্য মেলায় ঝাড়ু বিক্রি করছিলেন। তার পরনে ছিল সাদা রঙয়ের টপ ও সবুজ রঙয়ের স্কার্ট। হাতের ঝাড়ুতেও ছিল সবুজ রঙ।

ওয়ালাইপানের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পরিবারের সম্মতি আদায় করা। এই কাজকে পেশা হিসেবে নিতে পরিবারের সম্মতি পেতে তাকে অনেক কাঠখড় পোঁড়াতে হয়েছে। ওয়ালাইপান এখন দুই সন্তানের জননী। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি কখনোই কারো ব্যক্তিগত আসরগুলোতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।

‘প্রিটি ইন্ডাস্ট্রি’তে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের কাজ নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না। পুরোনো যোগাযোগ থেকে এমনিতে কাজের সুযোগ তাদের সামনে চলে আসে।

কিন্তু যাদের অভিজ্ঞতা ও যোগাযোগ নেই তারা কাজের খোঁজে বিভিন্ন এজেন্টের আশ্রয় নেন। এইসব এজেন্টরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ, চ্যাটগ্রুপ খুলে উঠতি মডেলদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

১০ বছর ধরে এই শিল্পে আছেন তিতছায়া থিভারারোজ (৩০)। কাজ পেতে তাকে যোগাযোগের জন্য কখনোই এজেন্টের প্রয়োজন হয়নি। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই কাজ পায় সে। তার সঙ্গে যেদিন কথা হয় সেদিন থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ বিভাগের একটি প্রদর্শনীতে কাজ করছিল তিতছায়া।

তিনি বলেন, সাধারণত আমরা এ ধরনের প্রদর্শনীতে এমন ধরনের কাপড় পরি না যাতে শরীরের বেশির ভাগ অংশই প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানের আগেই আয়োজকরা আমাদের আউট ফিটের নমুনার ছবি পাঠিয়ে দেন। ছবিতে যদি দেখি তাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ প্রদর্শন করা হচ্ছে তাহলে আমি কাজটাই ফিরিয়ে দেই। বিষয়টা আসলে নিজের কাছে।

সরকারি এই প্রদর্শনীতে তিনদিন কাজ করেই ১২ হাজার থাই বাথ পাবেন তিতছায়া। তার মতে অধিক উপার্জনের সুযোগ থাকায় তিনি এ পেশায় আছেন। কিন্তু যারা ব্যক্তিগত আসরগুলোতে মনোরঞ্জনে যায় তাদের উপার্জন কিন্তু খুব বেশি নয়।

ব্যক্তিগত আসরগুলোতে ডান্সার ও প্রিটিজ পাঠানোর কাজ করেন কেতসারা প্রন্নিকম। তিনি বলেন, এক সন্ধ্যা কিংবা সেশনের জন্য মনোরঞ্জনের যাওয়া কোন তরুণীর গড় উপার্জন হতে পারে ১৫০০ বাথের মতো। আর এজন্য হয়তো তাদের অনেক কিছুই করতে হতে পারে। এখানে কোনো নিয়ম নেই। এটা পুরোটাই নির্ভর করে আয়োজকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর।

কেতসারা জানান, তিনি যেসব নারীদের নিয়ে কাজ করেন তাদের বয়স ১৮-২৬ বছরের মধ্যে। ভালো সুযোগের সন্ধানে যারা রাজধানীর বাইরের শহর থেকে এসেছেন। অনেকেই আছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী যারা হয়ত উপার্জন করে নিজেকে ও পরিবারকে সহায়তা করতে চান।

ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকার দিকটি কী দূর হবে না জানতে চাইলে ওয়ালাইপান বলেন, যতদিন চাহিদা থাকবে আর উঠতি বয়সী তরুণীরা বেশি উপার্জনের পায়তারা করবে ততদিন এই শিল্পের অন্ধকার দিকটি থাকবেই। দুয়েকটি মৃত্যুতে তাদের কিছু যাবে আসবে না। তিথিমার মৃত্যুর পরেরদিনও ব্যক্তিগত আসর জমিয়ে তুলতে নারীদের খোঁজে ছিল এজেন্টরা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর