বিজ্ঞানী থেকে রাষ্ট্রপতি

ভারত, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-22 16:36:37

ইংরেজি ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ জিনিয়াস (Genius), যার বাংলা করা যেতে পারে প্রতিভাবান। সমকালের দক্ষিণ এশিয়ায় একজন প্রতিভাবান মানুষ চরম বিরূপ পরিস্থিতি ঠেলে শীর্ষ বিজ্ঞানীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। এমনকি, হয়েছিলেন তার দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। শ্রম, মেধা, সততা ও ব্যক্তিত্বে তিনি ছিলেন সকলের কাছে অনুকরণীয় এবং তার প্রজন্মের অনন্য একজন।

তার পূর্ণ নামটি বেশ দীর্ঘ, আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম। সংক্ষেপে তাকে ডাকা হয় এপিজেএ আবুল কালাম। ১৫ অক্টোবর, ১৯৩১ সালে (বৃহস্পতিবার) ভারতের সর্বদক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্রতটে তার জন্ম হয় আর তিনি মারা যান ভারতের সর্ব উত্তর-পূর্বের পার্বত্য শহর মেঘালয়ের রাজধানী শিলং-এ, ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই (সোমবার)।

তার মৃত্যুটিও বড় অদ্ভুত এবং ইঙ্গিতবহ। মানবিক এই মানুষ মারা যান এমন একটি পরিস্থিতিতে, যখন তিনি মেঘালয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজম্যান্টে 'বাসযোগ্য পৃথিবী' বিষয়ে বক্তব্য রাখছিলেন। সারা জীবনের মতো মৃত্যুতেও তিনি মানুষ ও পৃথিবীর কল্যাণে তার কণ্ঠকে উচ্চকিত রেখেছিলেন।

কালামের জন্ম তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম গ্রামের এক মুসলিম-তামিল পরিবারে। তার পিতা জয়নুল-আবেদিন ছিলেন একজন নৌকামালিক এবং মাতা অশিয়াম্মা ছিলেন গৃহবধূ। তার পিতা রামেশ্বরম ও অধুনা-বিলুপ্ত ধনুষ্কোডির মধ্যে হিন্দুতীর্থযাত্রীদের নৌকায় পারাপার করাতেন।

কালামের পরিবার ছিল অত্যন্ত গরিব। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাকে কাজ করা শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পিতাকে সাহায্য করার জন্য তাকে সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করতে হয়। বিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র। কিন্তু তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর পরিশ্রমী ছাত্র। তার শিক্ষাগ্রহণের তীব্র বাসনা ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি পড়াশোনা করতেন ও অঙ্ক কষতেন।

রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর কালাম তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফস কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে সেই কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন। পাঠক্রমের শেষের দিকে তিনি পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে চার বছর ওই বিষয় অধ্যয়ন করে সময় নষ্ট করার জন্য তিনি আক্ষেপ করতেন।

১৯৫৫ সালে তিনি মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) চলে আসেন। এখানকার মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে তিনি বিমানপ্রযুক্তি শিক্ষা করেন।একটি সিনিয়র ক্লাস প্রোজেক্টে কাজ করার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিন তার কাজে অগ্রগতি না দেখে অসন্তুষ্ট হন। তিনি ভয় দেখান তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে তার বৃত্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কালাম তিন দিনেই কাজ শেষ করেন। তা দেখে ডিন খুশি হন। পরে তিনি কালামকে লিখেছিলেন, 'আমি তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। তোমাকে এমন সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলেছিলাম যা করা খুব শক্ত।'

পরিশ্রমী আব্দুল কালাম অল্পের জন্য যোদ্ধা পাইলট হওয়ার সুযোগ হারান। উক্ত পরীক্ষায় ভারতীয় বিমান বাহিনির আট জন কর্মীর দরকার ছিল। তিনি পরীক্ষায় নবম হয়েছিলেন। এই সুযোগ না পেলেও তিনি পেয়েছিলেন আরও বৃহত্তর কাজের ক্ষেত্র।

আব্দুল কালাম খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। ছিলেন কঠোর অধ্যাবসায়ী। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। পেশাগত জীবনে তিনি বহুবিধ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। চল্লিশ বছর তিনি প্রধানত 'রক্ষা অনুসন্ধান ও বিকাশ সংগঠন' (ডিআরডিও) ও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো) বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। ভারতের 'অসামরিক মহাকাশ কর্মসূচি ও সামরিক সুসংহত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচি'র সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন।। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেটউন্নয়নের কাজে তার অবদানের জন্য তাকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়।

১৯৯৮ সালে ভারতে 'পোখরান-২' পরমাণু বোমা পরীক্ষায় আবুল কালাম প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। এটি ছিল ১৯৭৪ সালে 'স্মাইলিং বুদ্ধ' নামে পরিচিত প্রথম পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর দ্বিতীয় পরমাণু বোমা পরীক্ষা।

তাছাড়া তিনি ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী যান (এসএলভি)-এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, যা 'রোহিণী' কৃত্রিম উপগ্রহকে তার কক্ষপথে স্থাপন করে। কালাম প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থায় স্বাধীনভাবে একটি বর্ধমান রকেট প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। তিনি সরকারে অনুমোদন লাভ করেন এবং আরও কয়েকজন প্রকৌশলীকে নিয়ে এই প্রোগ্রামের ব্যপ্তি ঘটান। এবং শেষ পর্যন্ত সফল হন।

পরে আব্দুল কালাম ঘটনাচক্রে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে কালাম তৎকালীন শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পাঁচ বছর এই পদে আসীন থাকার পর তিনি শিক্ষাবিদ, লেখক ও জনসেবকের সাধারণ জীবন বেছে নেন। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন এবং আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছিলেন কালাম।

রাষ্ট্রপতি পদেও তিনি সততা, কৃচ্ছ্রব্রত, পরহিতের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অকৃতদার জীবনে তিনি ভোগ ও বিলাসের পথে কখনো চলেন নি। বিজ্ঞানীর মতো জ্ঞান সাধনা ও শ্রমের জীবনই ছিল তার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।

ব্যক্তির অসাধারণ সৃজনীশক্তি, ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট গুণাবলীর বিশেষ প্রতিফলন তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি অন্তঃর্নিহিত বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সক্ষমতা, সৃজনশীলতা অথবা জন্মগত ও প্রকৃতিগতভাবে একে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। ফলে এসব গুণাবলীর অধিকারী হিসাবে তিনি প্রতিভাবান রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে।

প্রাচীন রোমে পৌরাণিক উপকথায় জিনিয়াস বা প্রতিভাবানকে সমাজের পথপ্রদর্শকস্বরূপ বিবেচনা করা হতো। আত্মিক অথবা অধিষ্ঠাত্রী কখনো দেবতা বা ব্যক্তিকেও নির্দেশ করতো। সম্রাট অগাস্টাসের সময়কালে শব্দটির ব্যবহার ব্যক্তিমানুষের মধ্যে বিশেষভাবে মেধাবীদের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়। আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম একবিংশ শতাব্দীর ভারতের অন্যতম প্রধান প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। জীবন ও কর্মের নিরিখে তিনি সতত স্মরণীয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর