রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারে পশ্চিমা পর্যটক কমেছে

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-30 05:35:03

রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা মিয়ানমারের পর্যটন শিল্পে সংকট সৃষ্টি করেছে। কারণ চলতি বছর দেশটিতে কমেছে পশ্চিমা পর্যটকদের সংখ্যা। বিশেষ করে দেশটির উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে দেশটির পর্যটন শিল্পে বিশাল অর্থনৈতিক ঘাটতি হতে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের হোটেল ও পর্যটন মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের আগস্টে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির ওপর সামরিক অভিযানের পর থেকে পশ্চিমা পর্যটকদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। পরবর্তীতে সরকারি বাহিনীর নিয়মিত নির্যাতনে উত্তর রাখাইনের সাত লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিয়েছে।

মিয়ানমারের হোটেল ও পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মিয়ানমারে মাত্র এক লাখ ১০ হাজার পশ্চিমা পর্যটক (ইউরোপীয়) এসেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ কম। ফলে মিয়ানমারের পর্যটনকে জনপ্রিয় করতে ভিসার নিয়ম শিথিল করার পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, দেশটির সরকার মিয়ানমারকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করতে এবং পর্যটন শিল্প উন্নয়নে পর্যটকদের সহজ প্রবেশাধিকার বিধি প্রবর্তন করেছে। অক্টোবরের শুরু থেকে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, স্পেন এবং সুইজারল্যান্ডের পর্যটকরা ইয়াঙ্গুন, মান্ডলে ও নেপিডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে অন এরাইভাল ভিসা নিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারছেন।

এছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও ম্যাকাও থেকে আগত পর্যটকদের গত বছর ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ভারতীয় ও মূল ভূখণ্ডের চীনা নাগরিকদের অন এরাইভাল ভিসা দেওয়া হয়।

মিয়ানমারে পশ্চিমা পর্যটক

মিয়ানমার ট্যুরিজম মার্কেটিংয়ের চেয়ারপারসন মায়াট সোম উইন এ সস্পর্কে দেশটির গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমরা আশা করি, নতুন আইন পর্যটকদের মিয়ানমারের সংস্কৃতি ও সর্বপরি জনগণের আতিথেয়তা গ্রহণে উৎসাহিত করবে।’

মিয়ানমার ট্যুরিজম মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সচিব ফিউ ফিউ মারো বলেন, ‘ভিসা সহজলভ্য হওয়ায় পর্যটকদের কিছুটা আকর্ষণ করতে পারে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। এক সময় মিয়ানমার পশ্চিমা পর্যটকদের কাছে প্রিয় গন্তব্য ছিল। বিশেষ করে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জন্য। পাশাপাশি বাগানের মন্দির, ইয়াঙ্গুন ও মান্ডল শহরগুলোর মতো প্রাচীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের আকৃষ্ট করতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটন বিকাশে আরও নতুন গন্তব্য তৈরি করতে হবে। তার সঙ্গে ভালো পরিবহন ব্যবস্থা ও সুন্দর আবাসন পরিকাঠামো তৈরি করা দরকার।’

মান্ডলভিত্তিক ট্যুর অপারেটর ইউ ময়ো ইয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, যে সময় ছয় পশ্চিমা দেশের ভিসা বিধি সহজ করা হয়েছে তার অনেক আগেই পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। ফলে ট্রাভেল অপারেটররা প্রস্তুতির জন্য বেশি সময় পাননি।

হোটেল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপ-মহাপরিচালক কিন থান উইন জানিয়েছেন, এই বছর ভ্রমণে পর্যটকদের বিশেষ সুযোগ দিতে বিলম্ব হয়েছে। ইতোমধ্যে মৌসুম শুরু হওয়ায় এখন আর প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনা নেই। আমাদের চীন যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বাজার প্রসারের প্রয়াস হিসাবে মন্ত্রণালয় ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করছে।

মিয়ানমারের আকর্ষণীয় স্থান

তিনি আরও জানান, চীনা পর্যটক বেশি আসায় পশ্চিমা পর্যটকদের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ১২ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক মিয়ানমার সফর করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন লাখ বা ৩৯ শতাংশ বেশি। এখানে প্রতিবেশী জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন থেকে আগত পর্যটকদের ভূমিকা বেশি।

আরও জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর মিয়ানমারে চীনা পর্যটক বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৬০ শতাংশ। তবে তাদের বেশিরভাগ পর্যটকের বাজেট কম হওয়ায় মুনাফা প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। তবে জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং স্পেনের পর্যটকরা সাধারণত মিয়ানমারে প্রায় দুই সপ্তাহ থাকেন এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তারা চীনাদের চেয়ে ৪-৫ গুণ অর্থ খরচ করেন।

ইতালীয় ভাষী ট্যুর গাইড ইউ অং টুন লিন আশা প্রকাশ করে জানান, পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ভিসা শিথিল করায় এখন বেশি পর্যটক আসবে। তবে এ পর্যন্ত ট্যুর গাইডগুলো গত বছরের তুলনায় কম পর্যটক পেয়েছে।

মিয়ানমারের স্থানীয় পর্যটন বিশেষজ্ঞ ইউ থ্যাট লুইন টো বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ভিসা সহজ করা নিয়ে এক বছর ধরে টানাটানি চলেছে। দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে শুধু ইস্ট নীতি যথেষ্ট নয়, ওয়েস্ট নীতিও থাকতে হবে। অন্যথায় পর্যটনের মূল বাজার অদৃশ্য হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের পর্যটন শিল্প এখন শুধুমাত্র ভলিউমের ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে, মানের ওপর নয়।

পর্যটন অঞ্চল বাগান-ভিত্তিক একটি হোটেলের পরিচালক ও উপদেষ্টা ইউ মো ওয়াই ইয়ান বলেন, যখনই দেশের কোনও স্থান অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে তখনও সরকারকে কথা বলা উচিৎ। তাহলেই বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় যেতে তাদের বাধা দেওয়া যেতে পারে। সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটকদের আকর্ষণ করা সম্ভব। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এটা কেন করে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত না। তবে কোনও ঘটনা ঘটার সাথে সাথে মার্কিন দূতাবাস পর্যটকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর