ব্রিটিশ নির্বাচন, ব্রেক্সিট ও স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে

ইউরোপ, আন্তর্জাতিক

রকিবুল সুলভ,নিউজরুম এডিটর,বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 08:38:54

পৃথিবীর নানা প্রান্তে চলছে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। অর্থনীতি-রাজনীতির হিসেব চুকিয়ে এসব আন্দোলন কখনো সফল আবার কখনো ব্যর্থ। এমনই ভাবে বারংবার ব্যর্থ হয়েও সরে দাঁড়ায়নি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীরা। স্বেচ্ছায় পরাধীনতার শিকল পড়ার ৩০০ বছরেরও বেশি সময় পর ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা পেতে চায় তারা।

২০১৪ সালে এক গণভোটে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীরা হেরে যায় ঠিকই তবে আশা ছাড়েনি। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিও যে কম শক্তিশালী নয়। দুপক্ষের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় কার হবে সে কথা ভবিষ্যৎ বলবে আর পুরনো হলে ইতিহাস লিখে রাখবে।

ব্রেক্সিট ইস্যু স্কটিশদের স্বাধীনতায় আশার আলো দেখায়। কেননা ২০১৬ সালে গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে ৬২ শতাংশ স্কটিশ অবস্থান নেয়। তবে কি স্কটিশরা ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতার ইঙ্গিত দিচ্ছে?

স্কটল্যান্ডে ব্রেক্সিটবিরোধী আন্দোলন 

ব্রেক্সিটের নতুন দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি। তবে এর আগেই ১২ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। ২০২১ সালের ৫ই মে স্কটল্যান্ডের বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগেই এ সাধারণ নির্বাচনে যাচ্ছে দেশটি।

স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসপিএন) প্রধান ও ফার্স্ট মিনিস্টার বা মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টার্জন ২০২১ সালের মে মাসের আগেই স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতির ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু যেহেতু সামনে সাধারণ নির্বাচন, তাই তার নজর নির্বাচনকে ঘিরেই।

এদিকে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ কার্যকরে অবিচল প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঐক্যের কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় স্কটল্যান্ডে কোন গণভোট আয়োজন করতে দেবেন না। শুধু বরিসই প্রথম নন, এর আগেও ব্রিটিশ ক্ষমতায় যারা এসেছেন তাদের সবাই স্কটিশদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন।

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের তুলনামূলক গ্রাফচিত্র

তবে কোন পথে যাবে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন? এই আন্দোলন কি ইউরোপে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই অনিশ্চিত।

স্কটিশদের স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে মার্জিন লাইন হিসেবে যে বিষয়গুলো ক্রিয়া করে সেগুলো হচ্ছে- রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, কৃষি, সীমানা নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসন, নাগরিকত্ব, জনকল্যাণ, প্রতিরক্ষা, পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ন্যাটো-র সদস্যপদ, মুদ্রা, তেল, শিক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি ।

স্কটিশদের ভাগ্য নির্ধারিত হয় লন্ডন থেকে। আর ভাগ্য নির্ধারক হিসেবে কাজ করে ক্ষমতাসীন দল। তারাই ঠিক করছে অর্থনীতি, অভিবাসন, প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র নীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। স্কটিশদের একটা বড় অংশ মনে করে এ ধরণের কর্মকাণ্ড গণতন্ত্র বহির্ভূত। তবে পাশাপাশি অন্য একটা দল এটিকে মেনেও নেয় এবং সাঁয় দেয়।

বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে স্কটল্যান্ডে। এখানে রয়েছে তেল, মৎস্য, পর্যটন ও প্রযুক্তির ন্যায় বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। ইউকে সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের-এর তেল সম্পদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ স্কটল্যান্ডের সমুদ্র সীমায়। ধারণা করা হয় এর পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি ব্যারেল। এছাড়া এর বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি পাউন্ড।

স্কটল্যান্ডের রপ্তানি আয়ের এটি বড় অংশ আসে হুইস্কি রপ্তানি করে। দেশটি ৫০০ কোটি পাউন্ড মূল্যের হুইস্কি রপ্তানি করে, যা মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ। যেহেতু স্কটল্যান্ড ব্রিটিশ শাসিত একটি অঞ্চল সেহেতু আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় ইংল্যান্ডে।

স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসপিএন) প্রধান ও ফার্স্ট মিনিস্টার বা মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টার্জন

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ‘এসএনপি’ হিসাব করে দেখাচ্ছে যে, এটি স্বাধীন হলে এর অর্থনৈতিক বিকাশ ও মুক্তি সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রায় ৫৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বের চতুর্দশ ধনী দেশ হতে পারে। বিশাল পরিমাণ তেল সম্পদের কারণে এখানে শিল্প বিপ্লব সম্ভব।

অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী অংশটি মনে করে, এক সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করা ব্রিটেন এখন পর্যন্ত বেশ শক্তিধর রাষ্ট্র। এছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের একটি ব্রিটেন। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতির দেশও এটি। সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবে এখনো প্রথম সারিতেই রয়েছে ব্রিটেন।

ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা নয়, বরং তারা ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ ধারণ করে। ৬ কোটি মানুষের বৃহত্তর অংশ থেকে পৃথক হয়ে ছোট দেশ হওয়ায় পারতপক্ষে কোন গৌরব নেই। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে ব্রিটিশরা। অধিকাংশ ব্রিটিশ মনে করে স্কটল্যান্ড নিজেদের কথা ভেবেই স্বাধীন হতে চাইবে না।

ব্রিটিশ সরকার কোনোভাবেই স্কটল্যান্ড-কে স্বাধীন হিসেবে দেখতে চায় না। যদি স্কটল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে, তবে শুধু মানচিত্রে এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকবে না এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও। এছাড়াও পাল্টে যাবে ভূ-রাজনীতি। এ কারণে ব্রিটেন বেশ চিন্তিত। স্কটিশরা স্বাধীন হলে ব্রিটেন প্রায় ৩২ শতাংশ ভূমি হারাবে। হারাবে প্রায় ৮ শতাংশ জনসংখ্যা

স্কটল্যান্ড যাতে স্বাধীনতা না চায়, সে জন্য দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আসছে। কোন কোন দল অতিরিক্ত ক্ষমতার লোভ দেখাচ্ছে। আবার কোনটি আবেগে ভাসাচ্ছে।

স্কটিশদের রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যা বর্তমানে ব্রিটেনের একটি অংশ হিসেবে ব্রিটিশ ঐতিহ্য হিসেবেই সমগ্র বিশ্বে পরিচিত হচ্ছে। যদি স্কটল্যান্ড স্বাধীন হয় তবে ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটবে। স্কটিশরা সাংস্কৃতিকভাবে স্বাধীন হবে। অন্যদিকে, স্কটিশরা বৃহৎ সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক পরিচয়ে পরিচিত হবে। এ কারণে স্কটিশদের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে মত তৈরি হয়েছে।

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে স্বাধীন স্কটল্যান্ড ১৬০৩ সালে একই রাজার শাসনে থাকার লক্ষে একত্রিত হয় ইংল্যান্ডের সঙ্গে। ১৭০৭ সালে ‘ট্রিটি অব ইউনিয়ন’ পাস করে সংসদ ভেঙ্গে কিংডম অব স্কটল্যান্ড যুক্ত হয় কিংডম অব ইংল্যান্ডের আইনসভা একত্রিত হয়। এই মিলনের নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন। ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত ভূখণ্ডের নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য।

১৯৬৭ সাল থেকে স্কটল্যান্ডকে নিজেদের মত শাসন করতে স্বপ্ন দেখছে স্কটিশরা। ১৯৭৯ ও ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত দুইটি গণভোটের পর ১৯৯৯ সালে স্কটিশ পার্লামেন্ট যাত্রা শুরু করে। ২০০৭ সালে আলেক্স সালমন্ডের নেতৃত্বে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।

২০১১ সালে স্কটল্যান্ডের নির্বাচনে জয় পায় জাতীয়তাবাদী স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। দলটির তৎকালীন প্রধান অ্যালেক্স স্যালমন্ড স্বাধীন স্কটল্যান্ড পক্ষে প্রচার চালাতে থাকেন। এর ফলে ২০১২ সালের অক্টোবরে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের ব্যাপারে একমত হয় যুক্তরাজ্য এবং স্কটিশ সরকার।

স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন 

নিজস্ব পতাকা, আইনসভা ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে স্কটল্যান্ড স্বায়ত্তশাসিত দেশ। দেশটির উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে উত্তর সাগর, দক্ষিণ-পূর্বে ইংল্যান্ড, দক্ষিণে সলওয়ে ফার্থ ও আইরিশ সাগর এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর ও নর্থ চ্যানেল, যা আয়ারল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। ভূ-রাজনৈতিক একতার ভিত্তিতে প্রায় ১৮৬টি দ্বীপ নিয়ে ৭৮ হাজার ৭৭২ বর্গকিলোমিটারের ৫ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটির স্বাধীনতা অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচন, ব্রেক্সিট ও অন্যান্য প্রভাবকের ওপর।

গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে অনেক রাষ্ট্রই স্বাধীন হয়েছে এবং তারা জাতিসংঘে যোগও দিয়েছে। যদি স্কটিশরা স্বাধীনতা পায় তবে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের আছে আদর্শ হয়ে থাকবে। একইসঙ্গে মিলবে তাদের গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর