চীনের সঙ্গে পানির নিচে তলিয়ে যাবে বাংলাদেশও!

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

ফাতিমা তুজ জোহরা, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 03:08:42

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সুমেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। চলতি মাসে আগস্ট মাসের এক পরিসংখ্যানে উঠে আসে এর ভয়াবহ চিত্র। যেখানে এক দিনেই বরফ খণ্ড গলেছে ১ হাজার ১০০ কোটি টন (১১ বিলিয়ন)।

এর ফলে সমুদ্র পৃষ্টের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে আর হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে সমুদ্রের উপকূলবর্তী দেশগুলো। শুধু হুমকির সম্মুখীন নয়, তলিয়ে যেতে পারে এসব দেশের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল শহর। এতে গোটা বিশ্বের মানুষ ও প্রাণির অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

বরফ ও হিমবাহ গলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের পানি

সম্প্রতি দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই দেশগুলোর তালিকা যেখানে নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আছে চীন। এছাড়া- ইন্ডিয়া তৃতীয় অবস্থানে, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড রয়েছে এই তালিকায়।

কেন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু এবং আবহাওয়া এই দুইটি পরিবর্তন ভিন্ন। জলবায়ু হচ্ছে কোনো অঞ্চলের আবহাওয়া বা বায়ুমণ্ডলের উপাদান সমূহের দীর্ঘদিনের (কমপক্ষে ৩০ বছরের) গড়। সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক পরিবর্তনের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়।

এছাড়াও জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ ও বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি। কার্বন নিঃসরণের কারণ হলো- জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে। এছাড়াও বন উজাড়, কল-কারখানা, গাড়ির কালো ধোঁয়া, এসি থেকে নির্গত এসএফসিক্স গ্যাস ইত্যাদি কারণে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতি প্রথমবারের মতো বিপজ্জনক প্রতীকী মাত্রা ‘৪০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)’ ছাড়িয়ে গেছে বলে সতর্ক করেন মার্কিন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা।

কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতি ৪০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)’ ছাড়িয়ে গেছে

এ তথ্য জানিয়ে বিশ্বে গ্রীনহাউস গ্যাসের রেকর্ড ছোঁয়ারও আভাস দিয়ে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি কমাতে হবে। না হলে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। গ্রানথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ও এনভায়রনমেন্ট অ্যাট লন্ডন স্কুল অবইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক বব ওয়ার্ড বলেন, লাখ লাখ বছরেও এ পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

১৭৫০ সালে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত করা এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বায়ুমণ্ডলে ৪০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানানো হয়। কার্বন ডাইঅক্সাইড অক্সিজেন থেকে ভারী হওয়ায় বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের স্থায়িত্ব বেশি। কার্বনডাই অক্সাইডের মূলত সূর্যের তাপ শোষণ করে। ফলে মারাত্মক হারে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত তাপ শোষণ করায় বেড়ে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা।

বায়ুমণ্ডলে ৪০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে

সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বর্তমান নিঃসরণ হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ °C (ডিগ্রী সেলসিয়াস) পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর ফলশ্রুতিতে বরফ ও হিমবাহ গলে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের পানি। সমুদ্র পৃষ্টের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ১০ কোটি মানুষ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাম্প্রতিক তথ্য মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ সমুদ্রের নোনা পানির ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। আর এই শতাব্দীর শেষে ক্ষতির শিকার মানুষের সংখ্যা সাত কোটিতে পৌঁছাবে।

চলতি বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল আইপিসিসি থেকে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলে হয়, যা আশঙ্কা করা হচ্ছে তার থেকে দ্রুত গতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিপদে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

এর আগের পরিসংখ্যান মতে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বাড়বে বলে দেখানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি এ তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যেই একই পরিমাণ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী দ্বিগুণ হারে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা বিশ্বে ২৫ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছ ৬৪ কোটিতে। বাংলাদেশে বৈশ্বিকগ্যাস নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হার ০.৩ শতাংশ। কিন্তু তা স্বত্তেও বাংলাদেশকে চূড়ান্ত মাশুল দিতে হবে।

বাংলাদেশে বৈশ্বিকগ্যাস নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হার ০.৩ শতাংশ

এক গবেষণায় দেখা যায়, গত তিন বছরে বিশ্বে যে অতিরিক্ত গরমের তাপ ভোগ করতে হয়েছে  তা বিগত ১২ বছর আগে নির্গত গ্যাসের কারণে হচ্ছে। ফলে আরও ১২ বছর পর নির্গত গ্যাসের পরিমাণ এর দ্বিগুণ হবে। তখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর এই দুর্যোগের শুরু হবে ২০৫০ সাল থেকেই। বিশ্বের সার্বিক মারাত্মক জলবায়ু দুর্যোগ হবে অপরিবর্তনীয়; মানুষসহ সকল জীব-গাছপালা হবে মৃত্যুমুখী। ২১০০ সালে নয়, মহা দুর্যোগ স্থায়ী হবে ২০৫০ সাল থেকেই। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমি পানির তলায় নিমজ্জিত হবে, দক্ষিণাঞ্চল থেকে উৎখাত হবে ৫-৭ কোটি মানুষ। ফলে ধ্বংস হবে আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি, ফসল ও সকল সম্পদ।

এর আগে ২০০৭ সালের জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্য মতে,  বিশ্বের গড় উষ্ণতা ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সমুদ্র স্ফীতি ১৮ সেন্টিমিটার থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে৷ চলতি বছর ৩০ অক্টোবর বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সমুদ্র পরিবর্তনের ভয়াবহতা নিয়ে। যার ফলে বেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলবর্তী দেশগুলো।

নতুন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চিত্র

যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এক সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ২০৫০ সাল অর্থাৎ আগামী ৩০ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাবে ভারত, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও জাপান। এসব দেশ সমূহে উপকূলে বসবাস করে ৩০ কোটি মানুষ।

পরিসংখ্যান বলছে, ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৪ কোটি মানুষ। প্রতি বছর তিন মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের পানি। সুতরাং শুধুমাত্র উপকূলে বসবাসের জন্য নয় এর বাইরেও বসবাস করা মানুষও ঝুঁকিতে রয়েছে।

পরিসংখ্যান মতে, ভারতের মুম্বাই শহরও দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুরোপুরি সমুদ্রের গর্ভে চলে যেতে পারে এবং থাইল্যান্ডের ১০ শতাংশ এলাকাও আছে এই ঝুঁকিতে। প্রশ্ন থেকে যায় এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে কিনা! যদিও এর আগে ৩০ বছরের বায়ু দূষণের মারাত্মক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।  

তবু গবেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তি পেতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয়াবহতা থেকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর