২০২০ নির্বাচন: মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তর কত দূর

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-26 20:27:58

মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের এখনও এক বছর বাকি। মিয়ানমারের ইতিহাসে কেবল ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনকেই অবাধ ও নিরপেক্ষ বিবেচনা করা হয়, যার ফলাফলও সবার কাছে স্বীকৃতি পায়।

২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন গণতান্ত্রিক মানদণ্ড কতটা পূরণ করবে, সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে মিয়ানমারের দুই জন বিশেষজ্ঞ স্থানীয় গণমাধ্যমে মতামত দিয়েছেন। তারা হলেন—পিপলস অ্যাসাইন্স ফর ক্রিডিবল ইলেকশনের (পিএসিই) নির্বাহী পরিচালক কো সাই ইয়ে কিউ এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর এ নিউ সোসাইটির (ডিপিএনএস) ভাইস চেয়ারম্যান মা নো নো হেতে সান।

পিএসিই’র নির্বাহী পরিচালক কো সাই ইয়ে কিউ বলেন, ১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ২০১৫ সালের নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল এবং এর ফলাফল স্বীকৃত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেও সামরিক সরকার ফলাফলের স্বীকৃতি দেয়নি। ২০১৫ সালের নির্বাচনের লক্ষ্য ছিল সমারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে গণতান্ত্রিক সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার শুভ সূচনা। এটি নিশ্চিত যে, ২০২০ সালের নির্বাচন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদি তা না হয় কিংবা নির্বাচন স্থগিত হয় তাহলে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে।

তিনি বলেন, ইদানীং আমরা গুজব শুনছি যে, নির্বাচন সামনে এগিয়ে আনা হবে বা পিছিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পরে, কেন্দ্রীয় (ইউনিয়ন) নির্বাচন কমিশনকে (ইউইসি) একটি নির্দিষ্ট মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে সন্দেহ দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

কো সাই ইয়ে কিউ আরও বলেন, ২০১৫ সালের নির্বাচন যদি ক্ষমতা স্থানান্তরের জন্য হয় তবে ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গণতন্ত্রের মানদণ্ড নির্ধারণ। বর্তমান নির্বাচনী আইন ২০০৮ সালের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে, যা সামরিক শাসনকর্তারা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন।

তিনি বলেন, এই আইনগুলো ২০২০ সালের পরিস্থিতি অনুসারে আর উপযুক্ত নয়। সুতরাং প্রশ্ন কিভাবে এটাকে আরও গণতান্ত্রিক করা যায়। মূল চ্যালেঞ্জটি হলো—প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের জন্য কতটা সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে পারা যায়, যেটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।

নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বর্তমান আইনি কাঠামোর আওতায় কমিশন কেবল ক্ষমতাসীন দলের কাছে দায়বদ্ধ। এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বলেন কো সাই ইয়ে কিউ।

তিনি বলেন, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইউ থেইন সেইনের প্রশাসন এই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, এটা নির্বাচন কমিশনের স্বতন্ত্র সদস্যদের আচরণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। উপরের নির্দেশে কমিশনের কর্তাব্যাক্তিরা আইনি পদক্ষেপ তাদের পক্ষে নিতে পারেন। এই আইনি কাঠামো সংশোধন করে মৌলিক পরিবর্তন করা উচিত।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর এ নিউ সোসাইটির (ডিপিএনএস) ভাইস চেয়ারম্যান মা নো নো হেতে সান বলেন, ডিপিএনএস ১৯৮৮-এর পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা মাত্র কয়েকটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। দলটি ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য দলীয় ব্যবস্থা অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে। দলীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী আইনের পরিবর্তন জরুরি। দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আমরা নির্বাচন কমিশনকে বরাবরই অচলাবস্থায় দেখেছি। আমরা কিছু করতে চাইলে আমাদের কমিশনের কাছে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা দরকার। নির্বাচনী সমস্যাগুলোর সমাধান করা কমিশনের দায়িত্ব। রাজনৈতিক দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্রতিনিধিত্বকারী জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং কোনও সংস্থাকে তাদের কার্যক্রম অবহিত করার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে রাখছে। আমরা যখন নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য দলগুলোর সাথে একত্রে গণতন্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করি তখন নির্বাচন কমিশন বিধিনিষেধ আরোপ করে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ছোট জেলা শহরে আয়োজক কমিটিগুলোর কার্যক্রম চালাতে বিভিন্ন আইনি বাধা আরোপ করেছে। আমি মনে করি না নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম এমন হওয়া উচিত। দলগুলোর উন্নতি ও বিকাশের জন্য তাদের সীমাবদ্ধ না করে উৎসাহিত করা উচিত। ২০০৮ সালের সংবিধান গঠনের জন্য পূর্ববর্তী সামরিক সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

বর্তমান সরকার ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর থেকে যা করা উচিত ছিল তা করেনি। তাই দলগুলোর প্রশ্ন—কেন ক্ষমতাসীন সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আইনের কোন পরিবর্তন করেনি। নির্বাচনী আইন পর্যালোচনা করা দরকার, সাংবিধানিক সংস্কারের পাশাপাশি সংশোধন করা দরকার, আবার কিছু আইন দীর্ঘমেয়াদে বদলানো দরকার। নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী আকারের পরিবর্তন আনাও জরুরি।

মা নো নো হেতে সান আরও বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচন যদি আমরা গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু করতে চাই এবং সমস্ত প্রতিযোগীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে চাই তবে প্রথমে কমিশনকে স্বচ্ছতা দেখাতে হবে। এটা করার জন্য রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা দরকার। এটা হলেই নির্বাচনের তারিখ নিয়ে গুজব থামবে এবং জনসাধারণের সন্দেহ দূর হবে। সুশীল সমাজের সংস্থাগুলোকে নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে অংশ নিতে এবং অবাধে জরিপ চালানোর অনুমতি দেওয়া দরকার। প্রচার-প্রচারণার নিয়মাবলী প্রকাশ করা উচিত।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা যদি রাষ্ট্রীয় তহবিল ব্যবহার করেন তবে তার রূপরেখা তৈরি করা দরকার। ভোটার তালিকা ঠিক করা প্রয়োজন। কোন দল ক্ষমতায় রয়েছে তার দিকে না তাকিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মানদণ্ড নির্ণয়ে মনোনিবেশ করা দরকার। সব রাজনৈতিক দল যেন সমানভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে সেটাই নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমান নির্বাচন কমিশন মিডিয়া ও সুশীল সমাজ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।

হেতে সান আরও বলেন, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলছি। তবে সেনাবাহিনী নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংবিধানের আওতায় সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করে। এটা ছোট দলগুলোর পক্ষে প্রচার চালানো কঠিন করে তোলে, রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সম্ভাব্য আসনগুলো সরিয়ে দেয়। যখন আসনগুলো কেড়ে নেওয়া হয় তখন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে কিনা তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা খুব জরুরি। দলগুলোকে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে জনসাধারণের সমর্থন চাওয়া উচিত। দলগুলোকে বুঝতে হবে যে, লোকেরা কেন তাদের নির্বাচন করে এবং নির্বাচিতরা কার প্রতিনিধিত্ব করেন সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা উচিত। তবেই নির্বাচনটি অর্থবহ হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর