রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপে মিয়ানমার

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান,স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 02:40:30

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) দায়ের করা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় ঘরে বাইরে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে মিয়ানমার। এই চাপে ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি ব্যক্তিগতভাবে তার সরকারের পক্ষে লড়বেন বলে তার অফিস থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। সু চি নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে একটি আইনি দলকে নেতৃত্ব দেবেন।

গত ১১ নভেম্বর পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মিয়ানমার গণহত্যা, ধর্ষণ এবং সম্প্রদায় ধ্বংসের মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের একটি দল হিসাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গণহত্যামূলক কাজ’ করেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার শুনানির জন্য ১০ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ১০ ডিসেম্বর শুনানি করবে গাম্বিয়া। আর ১১ ডিসেম্বর শুনানি করবে মিয়ানমার।

অন্যদিকে, ১৪ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)৷ তবে মিয়ানমার বলছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের এই উদ্যোগ কোনভাবেই আইনসংগত নয়৷ কারণ, মিয়ানমার এখনও আইসিসি সনদে স্বাক্ষর করেনি, তাই দেশটি এই ট্রাইব্যুনালের সদস্যও নয়৷ কিন্তু আইসিসি বলছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ সংস্থাটির সদস্য হওয়ায় এই তদন্তের এখতিয়ার তাদের রয়েছে৷

এ সম্পর্কে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, মিয়ানমার এ ইস্যুতে চাপে রয়েছে। তারা আইসিজে’ কে কোনোভাবে এড়াতে পারছে না। যদিও মিয়ানমার বলছে তারা আইসিসির সদস্য নয়। আইসিজে’র রায়ে যদি প্রমাণিত হয় গণহত্যা হয়েছে, তাহলে মিয়ানমার বিপদে পড়তে পারে। কারণ আইসিজে’তে মিয়ানমার স্বাক্ষর করেছে।

তিনি বলেন, আমার ধারণা মিয়ানমার আইসিজে’তে গিয়ে দুটি কথাই বলবে। এক মিয়ানমারে কোনো গণহত্যা হয়নি। অন্যদিকে নিজ দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করতে গিয়ে বেশ কিছু অবৈধ বাংলাদেশি পালিয়ে গেছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা মিয়ানমারের অনুরোধে তাদের সরকারিভাবে রোহিঙ্গা বলছি না, কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি বলা বন্ধ করেনি। প্রথম এক বছর আমরা মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারিনি। এখন যে চাপ মিয়ানমারের ওপর পড়েছে, তা ক্রমেই বাড়াতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে না।

মিয়ানমারের রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি কার্ডিনাল চার্লস বোরের বিবৃতিতে চাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি এ মানবিক সংকটের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে মিয়ানমারের সমস্ত মানুষকে এ বিষয়ে শাস্তি না দেওয়ার জন্য আরও বেশি সতর্ক হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি রোববার (১ ডিসেম্বর) মিয়ানমারের জনগণের কল্যাণকে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য সত্য সন্ধান করার জন্য বিশ্বকে অনুরোধ করেন।

এ দিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। কারেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজে ও আইসিসি’র মামলাকে স্বাগত জানিয়ে ৩ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অর্থনৈতিক অনুমোদনসহ আরও বেশি চাপ দেওয়া, যাতে সারাদেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার আক্রমণ বন্ধ করে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী তা’আং জাতীয় মুক্তি বাহিনী, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের সেনা - যারা উত্তর জোটের সদস্য- তারাও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) উত্তরে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

এই চাপের ফলেই মিয়ানমারে সু চির পক্ষে প্রচারণা করতেও দেখা গেছে। গণহত্যার অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া অং সান সু চি-র জন্য ভক্তরা তার সফরের ভ্রমণ খরচ তুলছে। নৈতিক সমর্থন দিতে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে সু চির সঙ্গে সেনাবাহিনীর নেতাদের ছবি সম্মেলিত বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায়
সমর্থক সমাবেশ, বিলবোর্ড এবং অনলাইনে পাশে থাকার কথা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বলেছেন, আমরা অনেক আগে থেকে মিয়ানমারকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছি। তারা রোহিঙ্গাদের এ দেশে ঠেলে দিয়ে ধারণা করেছিল আমরা এদের নিয়ে নেবো। এটি একবিংশ শতাব্দী। এখন একটি দেশ চাইলেই যা খুশি তা করতে পারে না। বসনিয়া গণহত্যা মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে উঠতে ৬ বছর লেগেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা মাত্র ২ বছরের মধ্যেই ফাইল হয়ে গেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর