কোন পথে মোড় নেবে ব্রেক্সিট!

ইউরোপ, আন্তর্জাতিক

ফাতিমা তুজ জোহরা, আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 14:48:21

ব্রেক্সিট ইস্যুতে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের আলোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসে একই টানাপোড়েনে পড়েন বরিস জনসন। যার জেরে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন জনসন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন অন্য নেতারাও। ফলে প্রথা ভেঙে ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নিরঙ্কুশ জয় পায় জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি।

তবে যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচন শুধু ব্রেক্সিট প্রসঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। ডিসেম্বরে ডাকা এ নির্বাচন অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভালো ফল বয়ে আনবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তবে আগাগোড়াই একরোখা ছিলেন কনজারভেটিভ দলের নেতা বরিস জনসন। ব্রেক্সিট ইস্যুতে টেরিজা মে’র আকস্মিক পদত্যাগের পর বরিস জনসনের নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল, ব্রেক্সিট-এক্সিটকে চলতি বছরের গেল অক্টোবরের মধ্যে সফল করবেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ব্রেক্সিটকে সফল করতে জেরেমি করবিনের লেবার পার্টি আর কনজারভেটিভদের মধ্যে দফারফা লেগেই ছিল। তবে বরিস জনসনও হাল ছাড়ার পাত্র নন। ব্রেক্সিটকে সফল করতে নির্বাচনের আহ্বান জানান তিনি। আর এই সিদ্ধান্তকে জনসনের ‘মস্ত ভুল’ বলে আখ্যা দিয়েছে রাজনৈতিক মহল। তবে জনসন কান দেননি কোনো আলোচনা কিংবা সমালোচনায়। তিনি নিজের কথায় নয়, জবাব দিয়েছেন জনগণের কথায়। আর এই নির্বাচন ধুলিসাৎ করেছে লেবার পার্টির ক্ষমতা জয়ের স্বপ্ন এবং একইসঙ্গে ব্রেক্সিট লাগামের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন জনসন।

কেন আলোচিত এই নির্বাচন:
যুক্তরাজ্য পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৃতীয় দফায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটিতে প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ১৯২৩ সালে দেশটিতে ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়েছিল।

তবে শুধু ব্রেক্সিট ইস্যুতেই এই নিয়ে টানা তৃতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে ২০১৬ সালের ২৩ জুন এবং ২০১৫ সালের ৭ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে এই নির্বাচনকে ৭০ বছরের মধ্যে ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ, ব্রেক্সিট-এক্সিটকে কেন্দ্র করে টানা তিন বছর ধরে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। একইসঙ্গে ব্রেক্সিট কবে, কীভাবে হবে অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার চুক্তি রচিত হবে এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এর আগে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পার্লামেন্টে অনুমোদন পায়নি বেক্সিট।

ব্রেক্সিট কার্যকর হলে যুক্তরাজ্যের সমাজ ও অর্থনীতিতে নিয়ে আসবে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ইস্যু এতটা প্রভাব ফেলবে। এ জন্যই ৭০ বছরের ইতিহাসে এই নির্বাচনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন কূটনীতিকরা।

ব্রেক্সিট আদ্যোপান্ত:
১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য ইইউতে যোগ দেয়। তখন এটির নাম ছিল- ইইসি (ইউরোপিয়ান ইকনোমিক কম্যুনিটি)। এর লক্ষ্য ছিল সুলভ মূল্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য ও অভিন্ন বাজারসুবিধা। ১৯৯৩ সালে ইইউ নিজস্ব মুদ্রা, নীতিমালা, নাগরিকদের জন্য সীমানামুক্ত বিচরণ যুক্ত করাসহ অনেকগুলো পরিবর্তন আনে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে ২৮টি দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জোট। এ জোটের সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে। এসব দেশের নাগরিকরা জোটভুক্ত যেকোনো দেশে গিয়ে থাকতে ও কাজ করতে পারেন।

যুক্তরাজ্য কেন ব্রেক্সিট চায়:
১৯৭৩ সালে যে দেশ ইইউতে যোগ দেয় তারা কেন বেরিয়ে যেতে চাইছে এ জোট থেকে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, যে ব্রেক্সিট সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছিল যুক্তরাজ্যে, সেটিই আবার যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনগণকে দিচ্ছে বাড়তি সুবিধা, যেমন- শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্থিক অনুদান ও সামজিক নিরাপত্তা। আর এর মধ্যে দিয়ে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বাড়তি সুবিধা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী নাগরিকদের মনে। যেখানে তারা জন্মগতভাবে একটি বাড়ি কিংবা গাড়ি কেনার অনুমোদন পেতে হিমশিম খাচ্ছেন; সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন নাগরিক হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো একই সময়ে সেসব সুবিধা ভোগ করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি একজন যুক্তরাজ্যের নাগরিকের আগেই সে এসব সুবিধা পাচ্ছেন। ফলে নিজ দেশে পরবাসী এ নীতিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিক। তাদের দাবি, নিরাপত্তার প্রশ্নেও এই দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অবাধনীতির দ্বার উন্মুক্ত নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

কোন পথে মোড় নেবে ব্রেক্সিট:
কনজারভেটিভ পার্টি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে শিগগিরই কার্যকর হতে যাচ্ছে ব্রেক্সিট। ইতোমধ্যে এমন আভাস দিয়ে জনসন বলেন, এই জয়ের মধ্য দিয়েই ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনব। তার এ কথা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আসছে ৩১ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবে যুক্তরাজ্য। তবে এখানেই এই সংকটের শেষ নয়। কারণ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে একটি বাণিজ্য সমঝোতা চুক্তি করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। আর কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বেরিয়ে যেতে চান বরিস জনসন। সুতরাং ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর কোন দিকে মোড় নেবে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য, সেটি ঘিরে প্রশ্ন এখন কূটনীতিকদের। আর তার পরবর্তী ইইউ’র সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য চুক্তি কতটা সফল হবে কিংবা জনসন কতটা সফল হতে পারবেন সেটিই বিবেচ্য বিষয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর