সময়টা ২০১৪ সালের শেষ দিকে। সিঙ্গাপুরের দাসকার রোডে একটি কুরিয়ার সার্ভিস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে বসে আছি। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক জহির ভাই (ছদ্মনাম)। বেলা তখন প্রায় ১২টা। জহির ভাই বললেন, চলেন একসঙ্গে রান্না করি দুপুরের খাবার। আরো প্রায় ৪০ বছর আগে জহির ভাই সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। এরপর নাগরিকত্ব পান এবং এখানেই বসবাস শুরু করেন।
চুলায় গরুর মাংস বসিয়ে গল্পে মাতি আমরা। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
মানুষ হিসেবে আপনি কি আবেগি?
ঠিক জানি না।
তাহলে, আপনাকে কয়েকটি চিঠি পড়াবো। চাঙ্গি প্রিজন সেল থেকে এসেছে।
আরেকজনের চিঠি পড়বো!
হুমম। পড়তে পারেন। কারণ চিঠিগুলো দেখে আমাকেই আবার লিখে ই-মেইল করতে হয়। পড়লে অনেক গল্প জানতে পারবেন।
চিঠিগুলো কি ছাপানো যাবে?
যাবে। তবে তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পর।
সিঙ্গাপুরের অভিবাসন আইন বেশ কঠোর। অবৈধ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। রুহুল আমিন (ছদ্মনাম) সিঙ্গাপুরে একটি লোহা ভাঙার কারখানায় চাকরি করতেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি দেশে ফিরে যাননি। এক দালালের আশ্বাসে সিঙ্গাপুরে থেকে যান এবং দালালকে টাকা দেন ভিসা নবায়নের জন্য। তবে এরপর আর দালালের দেখা পাননি।
পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রুহুল। জেল দেয়া হয় ৪ বছরের। তবে পরে সাজা কমিয়ে আনা হয়। বর্তমানে তিনি দেশে ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন জহির ভাই।
প্রবাসে একজন শ্রমিকের আবেগ, ভালবাসা, দেশে রেখে আসা স্ত্রী-সন্তানকে একবার দেখার আঁকুতি চিঠির প্রতিটি লাইনে। জহির ভাইয়ের সামনে বসে সেদিন পড়তে যেয়ে একটা চিঠিও পুরোটা পড়া সম্ভব হয়নি।
চিঠিতে ব্যবহৃত নামগুলো পরিবর্তন করে পরিবার এবং জহির ভাইয়ের কাছে লেখা প্রবাসী বাংলাদেশি কয়েদির একটি চিঠি তুলে ধরা হলো এখানে।
'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করলাম। শ্রদ্ধেয় জহির ভাই পত্রের শুরুতে আমার সালাম নিবেন। আশা করি আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় ভাল আছি। আমিও আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় ভাল আছি।
যাক পরসমাচার এই যে আপনার হাতের একটি চিঠি পেয়েছি। জহির ভাই, আপনার চিঠি পাওয়ার পর, আমার মনে যে কত আনন্দ পেয়েছি, আল্লাহ পাক তা জানেন। মনে হয়েছে, এই বিপদের সময়ও আপনি খেয়াল রেখেছেন। আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করি, আল্লাহ, জহির ভাইকে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার মালিক বানিয়ে দেও।
যাক জহির ভাই, আমার স্ত্রীকে বলবেন, রুহুল প্রতি মাসে দুটি চিঠি দেয়। অথচ আজ ১১ মাস হলো, আমার স্ত্রীর কোন চিঠি পাইনা।
জহির ভাই, আমার স্ত্রীকে বলবেন, ‘তোমার আমার সন্তানের চিন্তায় আমি পাগল হয়ে আছি।’ আর জহির ভাই, আমার স্ত্রীকে বলবেন, চিঠি আপনার কাছে ই-মেইল করতে বা ফ্যাক্স করতে। তারপর আমার কাছে আপনি পোস্ট করতে পারবেন।
যাক জহির ভাই, আমার স্ত্রীকে বলবেন, এক কপি ফুল ছবি পাঠাতে। আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে কত বড় হয়েছে সেটা দেখার জন্য।
যাক জহির ভাই, আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি চিঠি দিতে পারি না। কারণ আপনাকে চিঠি দিতে হলে জেলখানার অফিসারের অনুমতি নিতে হয়। আমার স্ত্রীকে বলবেন, নামায পড়তে এবং কোরআন শরীফ পড়তে।
জহির ভাই, আমার আব্বা আম্মা ও আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে কেমন আছে, আমাকে চিঠি দিয়ে অবশ্যই জানাবেন।
জহির ভাই, আপনার উপকারের দাম আমি কোনদিনই দিতে পারবো না।'