আজমিরের আনা সাগর

ভারত, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ অ্যাসোসিয়েট এডিটর বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:29:14

উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক শহর আজমিরে প্রবেশের সময় চোখে পড়বে মানব-সৃষ্ট অতিকায় হ্রদ, যার নাম আনা সাগর। কাশ্মীরের আইকন যেমন ডাল লেক, আজমিরে তেমনি আনা সাগর।

মুসলিম ও মুঘল শাসক পূর্বকালে রাজপুত, জাট, শিখ, মারাঠাগণ আজমিরকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারত শাসন করেন। রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে আজমি হলো দিল্লি, আগ্রা বা উত্তর ভারতের অন্যন্য শহর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন।

প্রাচীন গুরুত্ববাহী বহু নিদর্শন আজমিরে এখনও রয়েছে। রাজধানী জয়পুর থেকে রাজস্থানের ঊষর ও টিলাময় ভূমি পেরিয়ে আজমিরে প্রবেশের পর থেকে বহু স্থাপনা ও নিদর্শন নজর কাড়ে।

দখলদার ইংরেজরাও আজমিরে বহু কিছু করেছে। এর মধ্যে মেয়ো কলেজ অন্যতম, যা ভারতের নবাব ও বাদশাহের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার একটি এলিট কলেজ হিসাবে খ্যাত।

আজমিরের মূল আকর্ষণ হযরত খাজা মইনউদ্দিন চিশতি (রহ.)- এর মাজার ও দরগাহ জিয়ারত শেষে শহর দেখতে বের হই। খুবই ঐতিহ্যবাহী ও সাজানো শহর আজমির। হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ আমলের বহু স্থাপনা চোখে পড়ে। বিশাল জায়গা নিয়ে সুপরিকল্পিত গলফ কোর্স, প্রাসাদ ইত্যাদির পাশাপাশি দেখা মেলে উট আর ময়ূর।

বিকালের দিকে এসে পৌঁছাই আজমিরের ‘আনা সাগর’ দেখতে। নৈসর্গিক পরিবেশ, মৃদুমন্দ হাওয়া ও স্থির নীলজলরাশি মন ভরে দেয়। লেকের চারপাশে বাহারি ফুলের বিন্যাস, ওয়াকওয়ে ও বসার বেঞ্চগুলো যেন দু'হাতে ডাকছে পর্যটকদের।

লেকের পানিতে উত্তর ভারতের মেঘমুক্ত খটখটে আকাশের নীল রঙ বিম্বিত হয়েছে অপূর্ব বিন্যাসে। পানিতে নানা প্রজাতির মাছের জলকেলি ও মুক্ত হাঁসের অবাধ বিচরণ হৃদয়ে দোলা দেয়, চোখ জুড়ায়।

কিছু মানুষ মাছকে আগ্রহভরে খাবার দিচ্ছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহুজন। রাজস্থানের লোকগানের মরমী টানে মন উচাটন সুর ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনামা গায়ক।

আমাদের রাজস্থানী ড্রাইভার সুখবিন্দর জানালেন, সাধারণ মানুষ নগর জীবনের কোলাহল ছেড়ে সকালে বিকেলে ব্যস্ততার ফাঁকে প্রাকৃতিক ছোঁয়ায় উৎফুল্ল হওয়ার বাসনায় আনা সাগর-এর তীরে এসে ভিড় জমায়। ছুটির দিনে লেকের চারপাশে হাজার মানুষের মেলা জমে। জোৎস্না আলোকিত রাতে লেকের জলতরঙ্গে আলোকজ্জ্বল শহরের প্রতিবিম্ব পুলক ও শিহরণ জাগায়।

আনা সাগরের সঙ্গেও মিশে আছে মুঘল ঐতিহ্যের রেশ। পর্যটকদের বিশ্রাম ও অবকাশ সুবিধা নিশ্চিত করতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির আনাসাগরের তীরে ‘দওলতবাগ’ নামে একটি সবুজ উদ্যান এবং ১৬৩৭ সালে সম্রাট শাহজাহান মর্মর পাথরের ৫টি পাকা প্যাভিলিয়ন তৈরি করেন। মূলত মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাচীন লেকের নব-নির্মাতা রূপে গণ্য করা হয়।

আনা সাগরের তিন দিক খোলা হলেও একদিকের তীর ঘেঁষে পাহাড় সারি। সেই পাহাড়চুড়ায় ব্রিটিশ অফিসারদের জন্য নির্মিত সার্কিট হাউসটি দেখার মতো। আনা সাগরের নানা পাশে বাগান আর ভাস্কর্যের সমাবেশে পুরো এলাকাটিই একটি মনোরম আবহ লাভ করেছে।

আনা সাগর নাম হলেও মূলত তা মানবসৃষ্ট বিশালায়তনের হ্রদ। তারাঘুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ হৃদ তৈরি করেন দিল্লি ও রাজস্থানের রাজপুত শাসক মহারাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের (১১৩৫-১১৫০) বংশ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত এ হৃদ তৈরি করা হয় লুনী নদীতে বাঁধ দিয়ে অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। হ্রদের অববাহিকা অঞ্চল প্রায় ৫ কি.মি, গভীরতা ৪.৪মিটার এবং জমা পানির পরিমাণ ৫০ লাখ কিউবিক মিটার। তবে নানা পরিসংখ্যানে হ্রদের জায়গা ও জল-ধারণ ক্ষমতার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যে তারতম্য লক্ষ করা যায়। কয়েক শত বছরের সুপ্রাচীন স্থাপনার প্রকৃত তথ্য-পরিসংখ্যানও ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেকাংশে বদলে গেছে।

জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র আনা সাগরের কোলঘেঁষে শতাধিক আবাসিক হোটেল ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীসমৃদ্ধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, যা ঐতিহ্যের নান্দনিক বিন্যাসে ছন্দপতন ঘটিয়েছে। জানা গেলো, রাজস্থান হাইকোর্ট আনা সাগরের তীরে নতুন কোনও স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করার হ্রদটি অবক্ষয়ের কবল থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছে।

হ্রদের পাশে খানিক ঘুরাঘুরির পর মাঝে একটি ছোট্ট দ্বীপ-সদৃশ্য ভূমিতটে পৌঁছাই, সেখানে দেশি নৌকা ও স্পিডবোটে যাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে আরও আছে উত্তর ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ ও বিশ্রামাগার। লেকের চতুর্দিকের শান্ত জলের স্ফটিক-শুভ্র উপস্থিতিতে দ্বীপে বসে মন জুড়িয়ে যায়।

এতো প্রাচীন হলেও আনা সাগরের পানি এখনও স্বচ্ছ আর পরিচ্ছন্ন। হ্রদের ব্যবস্থাপনার মান ধরে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ দিতেই হয়। কারণ হ্রদের সৌন্দর্য ও নিষ্কলুষ অবয়ব বজায় রাখতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের কমতি নেই। শত শত বছর হাজার হাজার দর্শক এলেও হ্রদ যাতে নোংরা ও আবর্জনাময় না হয়, সেদিকে রয়েছে কর্তৃপক্ষের তীক্ষ্ণ নজর। আশেপাশের বর্জ্য ও ময়লা পানি যাতে হ্রদে না পড়ে সেজন্য ৮টি ছোট বড় ড্রেন নির্মিত হয়েছে।

একটি লোকপ্রিয় ঐতিহাসিক জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মপ্রচারক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ সুফি খাজা মুইনউদ্দিন চিশতী রহ. (১১৪১-১২৩৬) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আজমির আসেন। স্থানীয় জনগণ তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হ্রদের পানি ব্যবহারে বারণ করেন। তিনি তখন হ্রদের মাত্র এক পেয়ালা পানি দিতে তাঁদের অনুরোধ করলে তাঁরা সম্মত হয়। অলৌকিক ঘটনা ঘটে পরদিন ভোরে। দেখা যায় হ্রদের সব পানি শুকিয়ে গেছে। এতে স্থানীয় জনগণের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও ভীতির সৃষ্টি হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন হযরত খাজা সাহেব রহ. অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ ও আল্লাহর অলি। তাঁরা খাজা সাহেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন এবং ওই পেয়ালার পানি হ্রদে ফেলে দেয়ার হুকুম দেন।

আল্লাহর অশেষ কৃপায় পরদিন হ্রদ আবার পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। এটা হযরত খাজা সাহেবের কারামত। এর পর থেকে তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

আজমিরের অনন্য দর্শনীয় স্থান আনা সাগরের ইতিহাসেও মিশে আছে সুলতানুল হিন্দু খাজা মইনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর অম্লান স্মৃতি।

আরও পড়ুন: আজমির শরিফ: উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র

এ সম্পর্কিত আরও খবর