চীন মিয়ানমারে ‘সড়ক’ ছেড়ে পানিতে নামছে

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 09:42:26

নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ নিয়ে উচ্চ-গতির রেল পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় চীন বিকল্প ব্যবসায়িক রুট হিসাবে ইরাবতী নদীকে ব্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত গৃহযুদ্ধ ও নিরাপত্তা হুমকি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) স্বপ্নের ওপর বাধা সৃষ্টি করছে। চীন চেয়েছিল মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে দেশটির অস্থির উত্তরাঞ্চল হয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত একটি উচ্চ গতির রেলপথ নির্মাণ করার। কিন্তু স্থলে বেইজিংয়ের এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। মিয়ানমারের ইরাবতী নদী হয়ে একটি নিরাপদ বাণিজ্য রুট তৈরি করতে চীন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

এই জলপথ ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। মিয়ানমারের আধুনিক রাস্তা এবং রেল যোগাযোগের অভাব পূরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিকে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বিভক্ত করেছে।

মিয়ানমারে ৭০ বছর ধরে জাতিগত সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন চলে আসছে। মিয়ানমারের শাসকদল আর সেনাবাহিনীতে বর্মীদের সংখ্যা বেশী। দেশটিতে বর্মীদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬৮ শতাংশ। আর বাকী ৩২ শতাংশের মানুষ ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠী থেকে এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীরাই দেশটির ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর অধিকার দিতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য বর্তমানে মিয়ানমারে ৫৩টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে যারা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত।

ইরাবতী নদীতে ঔপনিবেশিক আমলের নৌযান

মিয়ানমার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের এক বছর পরই ঐ দেশের অসংখ্য নৃগোষ্ঠী সশস্ত্র প্রতিরোধে উঠেছিল, মূলত বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করে। কেরেন, কাচিন, পা-ওহ, শান, সোম, কেরেনি, আখা, কোকাং, পালাং, ওয়া, মংলা, লাহু, আরাকান, চিন, কায়ান এবং নাগা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কমপক্ষে ৫৩ টি বিদ্রোহী বাহিনী  এবং  দল গঠন করে যারা তাদের অধিকার দাবি করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মী সরকার তাদের অধিকার  পুরোপুরি দিতে চায়নি।

১৯৫৮, ১৯৬৩, ১৯৮০, ১৯৮৯, ১৯৯০ এবং ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন  এবং কেন্দ্রীয় সরকার বাহিনীর মধ্যে লড়াই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্ত্বেও, শান্তি আসেনি মিয়ানমারে।  উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালে মিয়ানমারের পশ্চিমে ২ লাখ মানুষ বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে প্রায় এক লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে দেশটির সেনার হাত থেকে বাঁচতে।

চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) রেল, সড়ক ও বন্দর নির্মাণের  মাধ্যমে সংযুক্ত করার জন্য একটি পরিকল্পনার নিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের বিকল্প পথ হিসেবে বেইজিংকে জ্বালানি ও অন্যান্য রসদ জোগানোর দায়িত্ব নিত এ স্থলপথ। এখানে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এটি মিয়ানমারকে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের স্বাক্ষর করা মহাপ্রকল্প বিআরআই-তে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার করেছে। এজন্য চীন নতুন বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সুরক্ষা শৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে রেখে  এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে বৈশ্বিক অবকাঠামো-নির্মাণ প্রকল্পে।

মিয়ানমারের জীবন্তসত্তা হিসেবে ও জাতির জলজ প্রাণ হিসাবে বিবেচিত ইরাবতী নদী এখন স্পষ্টতই বেইজিংয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে।  বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ইতোমধ্যে সমুদ্র সীমানা থেকে ইরাবতী নদীর ভিতরে এক হাজার ৩০০ কিলোমিটার বা অর্ধেক পথ ধরে নিয়মিত যাতায়াত করে। কাচিন রাজ্য ভামোতে এ যাত্রা শুরু হয় এবং নীচে যেখানে বেঁকে জলপথটি ভারত মহাসাগরের দিকে গিয়ে পড়ে।

বিশ্ব মানচিত্রে চীন মিয়ানমার জলপথ

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীনা ঠিকাদাররা এখন ভামোতে বিদ্যমান স্থলে সুবিধার নেওয়ার চেয়ে নতুন বড় বড় নদী বন্দর নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য সাইটগুলো জরিপ করা শুরু করেছে।

বহু বছর আগে থেকেই  দক্ষিণ-পশ্চিম ইউনান প্রদেশের রুইলির বাণিজ্যিক কেন্দ্রটিকে লুয়েজে একই প্রদেশের সীমান্ত-ক্রসিংয়ের সাথে সংযুক্ত করতে নতুন হাইওয়েগুলো নির্মিত হয়েছিল। যেখানে আগে থেকেই বৃহত্তর বাণিজ্য প্রবাহকে কাজে লাগানোর নতুন সুবিধা রয়েছে। বাণিজ্য রুট হিসেবে ইরাবতী ব্যবহারের জন্য চীনের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন নয়। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারি  পর্যালোচনার একটি নিবন্ধে যুক্তিযুক্তভাবে প্রথম এই বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছিল।

উত্তরে জাতিগত গুহযুদ্ধের বিক্ষোভ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পরিকল্পনাটিকে আতুর ঘরেই রেখেছে।

১৯৯৭  সালে চীন ও মিয়ানমার ইউনান থেকে ইরাবতী ও পাশ দিয়ে স্থল ও জল পরিবহন রুটের সম্ভাবতা নিয়ে প্রথম যৌথ সমীক্ষা চালিয়েছিল।

২০০১ সালের ডিসেম্বরে চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াং জেমিন মিয়ানমার সফরকালে আরও অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ১৯৮০ এর দশকের পর এই জাতীয় উচ্চপদস্থ চীনা আধিকারিকের এটি প্রথম সফর ছিল। জিয়াংয়ের পরিদর্শনকালে আরও সীমান্ত বাণিজ্য সহজ করার জন্য উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করেছে।

এরপরই ২০০২ সালের মার্চ মাসে চীন মিয়ানমারকে ‘হাইওয়ে-জলপথ সম্মিলিত পরিবহন সংক্রান্ত খসড়া চুক্তি’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব দেয়। কয়েক মাস পরে, চীন ইরাবতী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমারকে দুটি ড্রেজার সরবরাহ করেছিল যাতে বড় বড় বার্জগুলো চীনা পণ্য নিয়ে নদীতে চলাচল করতে পারে। তবে এখন চীন আরও আধুনিক ও ভবিষ্যৎ  পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের সফরের মূল বিষয় ছিল ৩৩ টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতার স্মারক স্বাক্ষর করা। যার মধ্যে নতুন নদী বন্দর ও সংযোগ মহাসড়কসহ ইরাবতীর পাশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রধান্য পেয়েছে। চীনের এ দৃষ্টিভঙ্গি কোনও অভিনব ধারণা নয়। প্রকৃতপক্ষে, নদী পরিবহন মিয়ানমারের বাণিজ্য প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে, বৃটিশ জলযান সংস্থা ৬শ'র  বেশি জাহাজ পরিচালনা করেছিল। বেশিরভাগ প্যাডেল স্টিমার ছিল, যা ইরাবতী এবং এর বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় চলাচল করত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমারে আক্রমণ করার সময় জাপানিরা ইরাবতীর এ জলপথে ব্যবহৃত জাহাজগুলো ব্যবহার করতে বাধা দেওয়ার জন্য সেই বহর গোটাই ধ্বংস করা হয়েছিল।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে 'বৃটিশ জলযান সংস্থা' জাতীয়করণ করা হয় এবং আরও অনেক ছোট নতুন বহর নিয়ে সরকারি অভ্যন্তরীণ পরিবহন বোর্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।

এখন, চীন সিএমইসি এবং বিআরআই নিয়ে এবার ইরাবতীর একসময়ের সমৃদ্ধ বাণিজ্য পথটি শীঘ্রই পুনরুদ্ধার করার দিকে ধাবিত হচ্ছে। মিয়ানমারের জীবনযাত্রাকে চীনের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও রসদ সংযোগে পরিণত করার উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে। ’

এদিকে, জানুয়ারিতে ইয়াঙ্গুনে অনুষ্ঠিত একটি ফোরামে কুনমিং-ভিত্তিক ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান লিউ জিনসিন বলেন,  ইরাবতীর উপর নতুন করে পুনর্গঠন ও নতুন বন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে।

লিউ বলেন,  ইরাবতীর পাশের অবকাঠামো ‘এখনও দুর্বল’ এবং বন্দরগুলো ‘সাহায্য ব্যতীত নির্মাণ করা একটি চ্যালেঞ্জ’ হতে পারে, সম্ভবত চীনা সহায়তা এটির সমাধান আনতে যাচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর