সংসদে থাকতে অনড় মিয়ানমার সেনারা

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

খুররম জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-25 17:31:04

মিয়ানমারের সংবিধান দেশটির সেনাবাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। আর এটি বদলে ফেলতে চায় অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছে দলটি।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কিত সংসদীয় বিতর্ক চলাকালে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন সামরিক সদস্য এবং তাদের সমর্থনকরী দল ইউএসডিপি’র আইন প্রণেতারা। এনএলডির প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, সেনাবাহিনীর শক্তি দুর্বল করা হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি হবে।

এ ধরনের হুমকি দেশটির ভঙ্গুর গণতন্ত্রের উত্তরণকে প্রভাবিত করবে। এ তীব্র বিরোধিতার মুখে এনএলডির সংশোধনী প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদে পাস করা কঠিন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কয়েকদিনব্যাপী উত্তেজিত আলোচনায় মিয়ানমারের সংসদ উত্তপ্ত ছিল। সর্বমোট ১৪৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে সেনা নিযুক্ত আইনা প্রনেতা ও এনএলডি থেকে ৫০ জন করে, ইউএসডিপি থেকে ২৬ জন এবং জাতিগত দলগুলোর সদস্যরা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।

বিতর্ক চলাকালে সবচেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংশোধনী প্রস্তাব ছিল এটি। সাংবিধানিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনীর ভেটো থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল এ সংশোধনীর মূল বিষয়।

সাংবিধানিক সংস্কারের মূল প্রতিবন্ধকতা হলো সামরিক বাহিনী দ্বারা কার্যকর ভেটো। যার জন্য সংবিধানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করে। সংবিধানের ৪৩৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সনদে প্রস্তাবিত পরিবর্তনের জন্য ৭৫ শতাংশেরও বেশি আইন প্রণেতাদের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে, যার অর্থ সামরিক অনুমোদন ছাড়া কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়।

বর্তমানে এনএলডি সংসদে ৫৯ শতাংশ আসন, জাতিগত সংখ্যালঘু দলগুলি ১১ শতাংশ, ইউএসডিপি ৫ শতাংশ এবং সামরিক বাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে ২৫ শতাংশ আসন রয়েছে।

এনএলডি সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাদ দিয়ে সংসদে ৭৫ শতাংশেরও বেশি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে এই সনদে সংশোধনী অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা প্রস্তাব করেছে।

যদিও এই প্রস্তাবটি নৃ-তাত্ত্বিক দলের আইন প্রণেতারা ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছেন, সামরিক ও ইউএসডিপি আইন প্রণেতারা এটিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা দাবি করেছেন, এটি জাতীয় ঐক্য ও সামরিক-নাগরিক সম্পর্কের ক্ষতি করবে।

সেনা-নিযুক্ত আইন প্রণেতাদের নেতৃত্বদানকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মং মাং প্রস্তাবিত সংশোধনীকে সেনাপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত সামরিক সদস্যদের বিরুদ্ধে বৈষম্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বলেন, এই ধরনের বৈষম্য নাগরিক-সামরিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং মিয়ানমার যে জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের মধ্য দিয়ে চলছে, তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

সামরিক ঘেষা ইউএসডিপির আইন প্রণেতা ইউ টিন আই বলেন, সংসদে সেনাবাহিনীর আসন হ্রাস করা এমন একটি অস্থিতিশীল সময়ে খুবই তাড়াহুড়ো পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে।

এনএলডি ২০২০ সালের নির্বাচনের পরে সামরিক বাহিনীর অংশীদারিত্ব ধীরে ধীরে ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, ২০২৫ সালের পরে ১০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের পরে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক আইনসভায় সমস্ত আসনের এক-চতুর্থাংশ অনির্বাচিত সামরিক অফিসারদের দখলে রয়েছে।

বিতর্ক চলাকালে, এনএলডি এবং নৃতাত্ত্বিক দলগুলোর আইন প্রণেতারা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য সামরিক-নিযুক্ত আইন প্রণেতাদের সংখ্যা কমানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

সামরিক ও ইউএসডিপি আইন প্রণেতারা বলেছেন, এই পদক্ষেপের অবাঞ্ছিত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তারা বলেছেন, ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে দেশটি সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ার সময় সামরিক বাহিনী দেশকে রক্ষা করেছিল।

সামরিক আইন প্রণেতা মেজর হেট লিন বলেন, ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে সংকটের পর সেনাবাহিনীর সংসদীয় উপস্থিতি সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল।

তিনি বলেন, সশস্ত্র দ্বন্দ্বের অবসান ঘটার আগে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক আইন প্রণেতাদের সংখ্যা হ্রাস করা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি ঘটাবে। প্রতিরক্ষা পরিষেবা রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশ নিতে সক্ষম।

এনএলডি এই বাক্যটি অপসারণের পরামর্শ দিয়েছে। তবে, সামরিক ও ইউএসডিপি সংসদ সদস্যরা বলছেন, ঐতিহ্যগত এবং ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ দেশকে ভাঙ্গন এবং অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ, বহুপক্ষীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এখনও প্রয়োজনীয়।

অন্য এক এনএলডি সংসদ সদস্য ইউ নাইং এইচ তু অং বলেন, গণতন্ত্রের এ জাতীয় ধারণা একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। দেশটি যেহেতু এখন একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের মধ্য দিয়ে চলছে তাই সংরক্ষিত ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই।

মিয়ানমারের সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে (গ) জরুরি অবস্থা চলাকালে কমান্ডার-ইন-চিফকে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করে। সমালোচকরা বলছেন, অনুচ্ছেদটি সামরিক প্রধানকে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছে।

এনএলডি’র প্রস্তাব হলো— জরুরি অবস্থার সময়ে রাষ্ট্রপতির কমান্ড গ্রহণ করা উচিত, তা নির্ধারণের জন্য সংসদে পাস হবে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনী এবং ইউএসডিপি আইন প্রণেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে প্রস্তাবটি। তারা বলছে, জরুরি অবস্থার সময়ে আইনসভার পক্ষে কোনও পরিকল্পনা কার্যকর করা অসম্ভব এবং এটি কেবলমাত্র সামরিক বাহিনীর পক্ষেই জাতীয় সংহতি এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম।

ইউএসডিপির আইন প্রণেতা ইউ মাউং মাইন্ট বলেন, যদি রাষ্ট্রপতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে কে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তার জন্য সংসদের একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করা উচিত। এ জাতীয় পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখা অসম্ভব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর