পাকিস্তানে আর্মি, মৌলবাদ ও ইমরানের রাজনৈতিক উত্থান

এশিয়া, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 07:16:54

ইমরান খানের পাল্লা এবার পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকেই বেশ ভারি ছিল। কারণ সেই পাল্লা ধরে এবার নিজেদের পুরো ওজন দিয়ে ঝুলে আছে পাকিস্তানের প্রবল প্রতাপশালী সেনাবাহিনী।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং প্রধানত ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে অনেক আগেই ‘‌খবর’‌ ছিল, রাওয়ালপিন্ডির খাকি উর্দিরা এবার ইমরানের মতো একজন অনভিজ্ঞ, আনাড়ি প্রশাসককেই বসাতে চাইছে দেশের মাথায়।

কেন চাইছে, সেটা প্রকাশিত সংবাদ বিবরণেই ছিল পরিষ্কারভাবে বর্ণিত। নওয়াজ শরিফ বা আসিফ জারদারি অনেক বেশি ঘাগু, পোড়খাওয়া রাজনীতিক, সব সময় বশে থাকেন না। সেখানে প্লেবয় ও খেলোয়াড় ইমরানকে পোষ মানানো সোজা।

তা ছাড়া পাকিস্তানের এলিট, অক্সফোর্ডে পড়া সেনাকর্তাদের সঙ্গে একই গোত্রের সাবেক ক্রিকেট সুপারস্টারের তালমিল অনেক ভাল হবে। পাকিস্তানের রাজনীতির দস্তুর মেনে নতুন নেতা ইমরান নিজের আখের গোছাবেন, কর্তারা নিজেদের।

কাজেই পাকিস্তানের সিভিল-মিলিটারি এলিট শ্রেণির পাশাপাশি সাবেক স্ত্রী জেমাইমা পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত, উৎসাহী, কৌতূহলী।

ফিরেও আসতে পারেন কি তিনি আবার?‌ ইমরানের দুই ছেলে সুলেইমান আর কাসিমের হাত ধরে?‌ অসুবিধে কোথায়?‌‌

কারণ এখন ইমরানের ঘর তো ফাঁকা। জেমাইমার দু’‌নম্বর সতিন, ইমরানের তৃতীয় বেগম তথা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বুশরা মানেকা এপ্রিলেই ইসলামাবাদের বানি গালা এলাকায় ইমরানের বিরাট প্রাসাদ ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন।

বাজারে জোর খবর, দুজনের আধ্যাত্মিক, সাংসারিক, সব পথই এখন দুটি দিকে গেছে বেঁকে। এই তিন নম্বর বিয়েটাও নাকি টিকছে না। যদিও কিছুদিন আগেই বুশরা মানেকার উকিল জোর গলায় দাবি করেছেন, তাঁর মক্কেল কোত্থাও যাননি, যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু বানি গালার পাড়া প্রতিবেশীরা বিলক্ষণ জানেন কী ঘটেছে।

মানেকার প্রথম পক্ষের দামড়া ছেলে খাওয়ার ফারিন মানেকা সেই যে নতুন বাবার বাড়িতে এসে জেঁকে বসেছিল, যাওয়ার নাম পর্যন্ত করছিল না। অথচ ইমরান নাকি বিয়ের আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন, বুশরা মানেকার বাপের বাড়ির লোকেরা যখন তখন এসে ‘‌কী দুলাভাই কেমন আছেন?‌’‌ বলে আড্ডা বসাতে পারবে না। ফলে রোজ বাড়ি ফিরে মানেকা–পুত্র খাওয়ারকে দেখলেই মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল খান সাহেবের। সেই থেকেই নাকি মিয়া–বিবির ঝগড়া শুরু!‌


আরও পড়ুন: ইমরানের জয়ে জেমাইমা: ‘‌আমার খোকার বাবা রাজা হবে!’‌‌


অবশ্য বুশরা মানেকাও জামাইমার মতোই নিতান্ত ভদ্রলোক। চুপচাপ গোস্বা করে নীরবে সরে গেছেন।

ইমরানের দ্বিতীয় বিবি রেহাম খানের মতো চিল্লিয়ে পাড়া মাত করেননি। বিবিসি টিভি–'র আবহাওয়া রিপোর্টার রেহাম বিয়ের ১০ মাসেই বুঝে গিয়েছিলেন হাওয়া খারাপ। বিয়েটা ভাঙার পর বই লিখে ফেললেন ইমরানের বেলাগাম ব্যভিচার, অগুন্তি মহিলা, এমনকি পুরুষদের সঙ্গেও ইমরানের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে!‌ সেই বইয়ের ছত্রে ছত্রে অবৈধ যৌনতার ব্যাখ্যান, ছত্রে ছত্রে গর্ভপাত। টুইটার, ট্যাবলয়েড সরগরম হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর কেচ্ছা নিয়ে।

বাধ্য হয়েই সেনা লেলিয়ে দিলেন ইমরান। অবশ্য তার আগে থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছিল রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর। পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমের ওপর জারি হয়েছিল অঘোষিত সেন্সরশিপ। নওয়াজ শরিফ সম্পর্কে কোনও ভাল কথা লেখা যাবে না। পাকিস্তান মুসলিম লিগের কোনও মিছিলের খবর করা যাবে না। সামরিক হেফাজত থেকে কারও ‘‌নিখোঁজ’‌ হওয়া, সামরিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে পশতুনদের প্রতিবাদ নিয়ে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। বিচারবিভাগের সমালোচনাও করা যাবে না।

এই ‘‌যাবে না’‌–র তালিকায় যুক্ত হয়েছিল রেহাম খানের বই। তার থেকে একটি লাইনও যাতে কোথাও তুলে না দেওয়া হয়, সতর্ক নজর রাখতে শুরু করেছিল সেনা কর্তৃপক্ষ। নয়তো ভোটের বছরে একা ইমরানের সাধ্য কি ওই কেচ্ছার আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর! এবং ভবিষ্যতেও সেনা–সখাদের হাত ধরেই হাঁটবেন ইমরান, যে ইমরান ২০১৩ সালের নির্বাচনী প্রচারে সদর্পে বলেছিলেন, পাকিস্তানে বকলমে সেনা শাসনের দিন শেষ!‌

অবশ্য এই ইমরানই তো একসময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, স্বদেশকে তালিবানমুক্ত করার শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু সময় তাঁকে শিখিয়েছে, সেনাবাহিনী এবং জঙ্গি মৌলবাদের দো–ধারী তলোয়ারের ওপর দিয়ে কীভাবে হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য ক্রমশই আরও পিছনের দিকে এগিয়ে গেলেন একদা অক্সফোর্ডের শিক্ষায় শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত ইমরান খান। হয়ে গেলেন আর্মি ও মৌলবাদের ইয়ার দোস্ত।

মিডিয়া বলেছে, এতো কিছুর পরেও পাকিস্তানের মহিলাকুল নাকি এবার ক্ষমাসুন্দর মুখে হুমড়িয়ে ভোট দিয়েছে ইমরানকে। প্রচার করছে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ'র পক্ষে।

কিন্তু বিরোধীরা বলছে, পুরোটাই রিগিং। মানুষকে ভোট দিতেই দেওয়া হয়নি। তাছাড়া এবার জিততে মরিয়া ইমরান যেভাবে মৌলবাদী নীতি আর সেনা অনুশাসনের পক্ষে কথা বলেছেন, বিশেষত দেশের মেয়েদের আরও বেশি মধ্যযুগীয় সঙ্কীর্ণতার বিধিনিষেধে আটকে রাখার তালিবানি উদ্যোগে সায় দিয়েছেন, মেয়েদের ভোট তাঁর পক্ষে যাওয়ার স্রেফ কোনও কারণ নেই। সে তিনি এই ৬৫ বছর বয়সেও যতই রমণীমোহন থাকুন না কেন!‌

পেছনের আর্মি আর মৌলবাদী প্রশ্রয়ের স্পষ্ট মদদ না থাকলে এতো ঘটনা ও কেলেঙ্কারির নায়ক পাকিস্তানের রাজনীতির নায়ক হয়ে উঠতে পারতেন না। আসলে, পাকিস্তানে আর্মি, মৌলবাদ ও ইমরানের রাজনৈতিক উত্থান একই স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর