করোনার প্রভাবে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা পৃথিবীর চেহারা। বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর পুরনো নিয়ম-কানুন। দেশে-দেশে মানুষের জীবন-যাপনের প্রণালীও বদলে যাচ্ছে। বাড়ছে বহুমুখী বিপদ এবং তৈরি হচ্ছে বিপদ মোকাবিলার পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি।
করোনার আকস্মিক আক্রমণে একবিংশ শতকের অতি-উন্নত, অতি-অগ্রসর, অতি-প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে। অচেনা এই মারণ ভাইরাসকে চেনা ও বোঝার আগেই অকাতরে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এক জায়গায় রোগের প্রতিরোধের আগেই ছড়িয়ে যাচ্ছে আরও অনেক জায়গায়। এমন আঘাতকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত ছিল না পৃথিবীর মানুষ।
পৃথিবী স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে গেছে। অনেক দেশে নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। শেয়ার বাজার ও বাণিজ্যে ধস নেমেছে। সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ। এভিয়েশন ও বিমান চলাচল ব্যবস্থা সংকুচিত। বেকার হচ্ছে বহু মানুষ।
যুদ্ধ, মারী, দুর্যোগের কারণে অতীতের পৃথিবী বার বার এমন মন্দা, অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। সংকট পেরিয়েই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ বেঁচে আছে। বিপদ ও সংকটে নানা প্রতিষেধক, টিকা, ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। সভ্যতার ইতিহাসে এভাবেই মানুষ এগিয়ে এসেছে নানা বিপদ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে।
করোনার প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই এর ভ্যাকসিন, টিকা ও প্রতিষেধকের বিষয়েও বিজ্ঞানিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও কিছু অগ্রগতির তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। ব্যক্তিগত ও সম্মেলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ভয়ংকর প্রকোপের কবল থেকে বাঁচার জন্য পালন করা হচ্ছে নানা বিধি-বিধান। পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিয়মেও এসেছে বিরাট পালাবদল।
মানুষে মানুষে মেলামেশা ও সংযোগের ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের প্রচলতি ধারণা ভেঙে যাচ্ছে। একবিংশ শতকের পৃথিবীর এমন প্রলয়ংকরী বিপদের মুখে বদলে যাচ্ছে যাবতীয় সম্পর্ক ও সংযোগের কাঠামো।
করোনার আগে ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, এইডস ইত্যাদি বিপদ পৃথিবীকে প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছিল। মানুষের আচরণ ও সম্পর্কের নেতিবাচক কারণেও বহু রোগ-ব্যাধি ছড়াতে পেরেছিল। এইডস’র ক্ষেত্রে অবাধ যৌনাচার, মেলামেলাকে দায়ী করা হয়েছিল।
করোনা ছড়ানোর পেছনেও মানুষের খাদ্যভাস, আচার-আচরণ, মেলামেশার ক্ষেত্রে নানা রকম ভুল পদক্ষেপের প্রভাব রয়েছে। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট করার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও কাজ করেছে এই চরম পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে। মানুষ যে নিজের ভুল কাজ ও পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপদ ডেকে আনছে, তা করোনার সময়ও প্রমাণিত হয়েছে।
সাধারণ স্বাস্থ্য বিধি, পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশের সুরক্ষা ইত্যাদি মৌলিক কাজে পৃথিবীর মানুষ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরাট ক্ষতিকর অবস্থায় আছে। নদী, পাহাড়, বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। নিজের বর্জ্য ও ব্যবহার্য দিয়ে চারপাশের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। নানা রকমের জৈব বর্জ্যের পাশাপাশি রাসায়নিক ও অন্যবিধ বর্জ্য দিয়ে দূষিত করছে পৃথিবীর পরিবেশ।
কোনও কোনও দেশ কেমিকেল, বায়োলজিক্যাল অস্ত্রের পাশাপাশি জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরিক্ষা-প্রয়োগের মাধ্যমে বিশেষ কোনও শত্রু দেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যই বিপদ ডেকে আনছে। এতো আঘাত, রক্তপাত, বোমাবাজি সর্বংসহা বসুন্ধরা আর কত সহ্য করবে!
পৃথিবী যে আসলেই একটি ‘ভুবন গ্রাম’ এবং একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে সবাই যে আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত দিক থেকে একাকার, সেটা মুখে বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে মান্য করা হচ্ছে না। শুধু বাণিজ্য ও আর্থিক লাভ নিয়ে উন্নত দেশগুলো সারা বিশ্বের সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য এবং নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে বিশেষ কোনও কাজই করছে না। বরং অনেক ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
এহেন নেতিবাচক বৈশ্বিক প্রবণতায় করোনা বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ ও মানুষকে জীবন ও যাপনের প্রচলিত কাঠামো সম্পর্কে নতুন করে ভাবার অবকাশ দিচ্ছে। প্রযুক্তি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে জীবন ও জীবিকাকে নতুন করে বিন্যস্ত করার প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ যাবত গৃহীত অমানবিক ও ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের মূল্যায়নে তা থেকে সরে আসার তাগিদও অনুভূত হচ্ছে করোনার মারাত্মক পরিস্থিতিতে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে জীবনপ্রণালির গুণগত পরিবর্তনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকেও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অফিসের বদলে বাসায় কাজ করা, নানাবিধ কাজ ও প্রয়োজনে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্টতার বদলে ই-যোগাযোগের বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করছে। পৃথিবীর প্রচলিত কাঠামো ও বিধি-ব্যবস্থার মধ্যেই একটি আমূল পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাসের আঘাতের প্রতিক্রিয়ায়।
আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ্ব বাণিজ্য ও অবাধ মুনাফার সুতীব্র প্রতিযোগিতাতেও লাগাম টানার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে করোনা। বিশ্বের প্রতি ‘সামাজিক দায়িত্ব’ পালনের জন্য ব্যক্তিগত শুদ্ধাচার ও পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের ভূমিকাকেও তীব্রতর করেছে করোনা।
এমতাবস্থায় করোনার বৈশ্বিক মহামারির পটভূমিতে বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র বিরাট অঙ্কের ফান্ড গঠন করেছে প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের জন্য। পৃথিবীকে যে সবাই মিলে রক্ষা করতে হবে এবং সকলের সম্মিলিত প্রতিরোধে বিপদ উত্তরণ করতে হবে, এই চেতনা যত বেশি বিকশিত হবে, ততই মানব সভ্যতার জন্য কল্যাণ আসবে।
বিভিন্ন ধরনের বিপদ, মহামারি, যুদ্ধ ও সংকটে যে মানব জাতি একাকার হয়ে এই সবুজ পৃথিবীকে রক্ষা করেছে, অতীতের সেই স্বর্ণালি অর্জনগুলোকে সামনে রেখে কাজ করতে হবে সবাইকে মিলেমিশে। করোনার কারণে বদলে যাওয়া বিশ্বকে আতঙ্ক, মৃত্যু, বিপদের কবল থেকে উদ্ধার করে শান্তি ও নিরাপত্তার আবাসে পরিণত করতে হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই।
প্রযুক্তির অতিবিকাশের জন্য পৃথিবী যেভাবে বদলে গেছে, করোনাসহ নানা রোগ ও আর্থ-সামাজিক-পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেও দ্রুত বদলে যাচ্ছে চিরচেনা পৃথিবীর চেহারা। এই নতুন চেহারা ও অবয়বের পৃথিবীকে নিরাপত্তাহীনতা, ভীতি ও আতঙ্কের বদলে মানবিকতা, শান্তি, সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার দ্বারা বাসযোগ্য রাখাই মানব সভ্যতার জন্য মিলিত চ্যালেঞ্জ।