করুণানিধির মৃত্যু: দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক সূর্যের অস্ত

ভারত, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 09:59:33

 

শতবর্ষ স্পর্শ করা আর হলো না। দক্ষিণ ভারতের উজ্জ্বল রাজনৈতিক সূর্য অস্তমিত হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তামিলনাড়ুর রাজনীতির প্রবল পুরুষ মুথুভেল করুণানিধি। বয়স হয়েছিল ৯৪। রেখে গেছেন সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতনের রোমাঞ্চে ভরা ইতিহাস, লক্ষ সমর্থক আর চার ছেলে ও দুই মেয়ে।

করুণানিধির স্বাস্থ্য নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছিল সোমবার (৬ আগস্ট) থেকেই। হাসপাতালের বুলেটিনে বলা হয়, অবস্থা গুরুতর। মঙ্গলবার (৭ আগস্ট) সকালে জানানো হয়, খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থা। সন্ধ্যায় ঘোষিত হয় মৃত্যুসংবাদ। দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় রাজনীতির দীর্ঘ একটি ঐতিহাসিক যুগের অবসান হল তাঁর মৃত্যতে।

নিজের রাজ্যের পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধি। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এম জি রামচন্দ্রন, পরে জয়ললিতা। দু‌জনই প্রয়াত। অবশেষে অবসান হল করুণানিধির যুগেরও।

মেরিনা বিচে আন্না দুরাইয়ের সমাধিভূমিতে করুণানিধির দেহ সমাহিত করার জন্য জমি চেয়েছেন ছেলে এম কে স্ট্যালিন। করুণানিধির প্রতিপক্ষ এখন রাজ্য সরকারে। তারা সমাধির জমি দিতে নারাজ। করুণানিধির দল ডিএমকে সমর্থকদের শোক এখন উত্তেজনায় ফুটছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সি রাজাগোপালাচারি এবং কে কামরাজের স্মারকের কাছে জমি দিতে চাইছে রাজ্য সরকার।

ডিএমকে মানছে না। ২০ মাস আগে মেরিনা বিচেই সমাধিস্থ করা হয় আরেক নেত্রী জয়ললিতাকে। করুণানিধির সমর্থকরা পাশেই নেতার চিরনিদ্রার জায়গা চান। ফলে সমাধিস্থল বিষয়ক বিতন্ডায় রাজনীতির এই সিংহপুরুষ মৃত্যুতেও পরিণত হয়েছেন গরম রাজনৈতিক ইস্যুতে

পুরো নাম মুথুভেল করুণানিধি। এই নামটিই যথেষ্ট গোটা তামিল ভাবাবেগের কাছে। ১৯২৪ সালে জন্ম এই তামিল পুত্রের। যিনি একাধারে আঁকতে পারতেন, লিখতে পারতেন চিত্রনাট্য। তামিল ফিল্ম জগতে এভাবেই তাঁর প্রথম প্রবেশ। অধিকাংশ জনপ্রিয় তামিল রাজনৈতিক নেতার মতো তাঁরও উত্থান রূপালি পর্দার পথ ধরে।

কিন্তু ছবিতেই এখানেই থেমে থাকেনি তাঁর প্রতিভা। নিজেকে এমনভাবেই তৈরি করেছিলেন যে তামিলবাসীরা তাঁকে দেখে বলতেন, 'আগুনকে কখনও ছাই দিয়ে চাপা দেওয়া যায় না।' হয়তো এটাই সত্যি। কারণ তামিল সাহিত্য জগতে তাঁর অবদান এককথায় অনস্বীকার্য। তাঁর লেখা গল্প, নাটক, উপন্যাস তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল তামিলনাড়ুর মানুষের মনের মণিকোঠায়। নিজের আবেগ দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় জাতির কষ্টের কথা। ঠিক করেছিলেন কিছু একটা করতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। ১৯৬৯–২০১১ পর্যন্ত নানা সময়ে পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসন তাঁকে তুলে দিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর মানুষ। আর টানা দশবার ডিএমকে দলের সভাপতি। উত্থান আর পতনের পরেও দক্ষিণের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সূর্যের মতো প্রখর আর উজ্জ্বল।

তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনাম জেলার তিরুকুভালাই গ্রামে জন্ম করুণানিধির। স্কুল জীবনেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পায়। জাস্টিস পার্টির নেতা আজাহাগিরিস্বামীর বক্তব্য তাঁর জীবনে রাজনৈতিক আবেগের ঝড় তুলে দেয়। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে সামাজিক আন্দোলনে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন বাদে তৈরি করেন অল স্টুডেন্টস ক্লাব। দ্রাবিড় আন্দোলনের এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ।

তারপর ১৯৫৩ সাল, তৈরি হয় ডিএমকে (‌দ্রাবিদা মুন্নেত্রা কাঝাগাম)‌। দলের মুখপত্র মুরাসোলি কাগজে লিখতে শুরু করেন তামিল রাজনীতি থেকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ। ভাষ্যকার হতেও সময় লাগেনি তাঁর। কাল্লাকুড়ি আন্দোলন তাঁকে তামিল রাজনীতিতে জনপ্রিয় করে তোলে। শিল্প শহরের আসল নাম ছিল কাল্লাগুড়ি। কিন্তু সেখানে সিমেন্টের প্রকল্প তৈরির নামে শহরের নাম বদলে করে দেওয়া হয় কাল্লাক্কুড়ি থেকে ডালমিয়াপুরম। শুরু হয় করুণানিধির আন্দোলন, পথ অবরোধ, ট্রেন অবরোধ, বিক্ষোভ। এই আন্দোলনের ফলে দু’‌জন মারা যায়। গ্রেপ্তার হন করুণানিধি।

১৯৫৭ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কুলিথালাই বিধানসভা আসন থেকে জয়ী হয়ে তামিলনাড়ু সংসদে প্রবেশ করেন তিনি। তারপর একের পর এক সাফল্য রাজনীতির ময়দানে। ১৯৬২ সালের বিরোধী দলনেতা এবং ১৯৬৭ সালে তাঁর হাত ধরে ক্ষমতায় আসে ডিএমকে। ১৯৬৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী। যিনি ৭০ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরী অবস্থার প্রতিবাদ করেছিল একমাত্র শাসকদল হিসাবে। যার ফলে তাঁর সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। বহু নেতাকে জেলে ভরাও হয়েছিল। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি এই তামিল নেতা।

লড়তে লড়তে আবার ময়দানে ফিরে আসার প্রচন্ড ক্ষমতা ছিল তার। জয়ললিতার মতো গ্ল্যামারাস নেত্রীকে টক্কর দিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে দৃঢ অবস্থান বাগিয়ে ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও ক্ষমতার পালাবদলে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। দূর দক্ষিণের রাজনৈতিক অনুঘটক হয়েও দিল্লির কেন্দ্র ছিল তাঁর সমীহ আদায় করার মতো দাপট।

করুণানিধি তীব্র তামিল জাতীয়তাবাদী আবেগের রাজনীতি করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তামিল স্বার্থে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতো জোর গলায় কেন্দ্রকে শাসানোর ক্ষমতা তাঁর মতো আর কারো ছিল না।

তাঁর মৃত্যুতে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক প্রাধান্য খর্ব হবে।  শিল্প-সাহিত্য জ্ঞানী রাজনীতিবিদের সংখ্যাও কমে আসবে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর চিরবিদায়ের ফলে ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদ আর নন্দন প্রভায় আলোকিত যে রাজনৈতিক সূর্য অস্তমিত হলো, গেমন সূর্য সহসাই উদিত হবে বলে মনে হয় না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর