তুরস্কে বাড়ছে করোনার বিপদ

, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 12:19:05

বৈশ্বিক মহামারি করোনার পরবর্তী প্রচণ্ড আঘাতটি পড়তে পারে তুরস্কে। তুরস্ক সেসব দেশের শীর্ষে রয়েছে, যেখানে করোনার বিপদ ক্রমেই দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এমন তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক জার্নাল 'ফরেন পলিসি'। করোনা প্রতিহতে দ্বিধান্বিত পদক্ষেপ ও দেশটির ভেতরের রাজনৈতিক বিভেদ তুরস্কে করোনার বিস্তার ঠেকানোর বদলে বাড়াচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে 'ফরেন পলিসি'।

যখন মনে করা হচ্ছিল, করোনার গতি হবে আফ্রিকার দিকে, তখন ইউরোপে ও এশিয়ায় মিলিত ভূগোল-সংস্কৃতির দেশ তুরস্কে করোনার থাবা বিস্তারের পূর্বাভাসে নতুন করে উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে।

'ফরেন পলিসি' জানিয়েছে, তুরস্কের করোনা পরিস্থিতি  ইতিমধ্যে চীনের সংখ্যাকে অতিক্রম করেছে। আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় তুরস্কের অবস্থা যেকোন সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভয়াবহ হয়ে যেতে পারে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী তুরস্কে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮৬,৩০৬ জন আর মারা গেছেন ২,০১৭ জন, যা ক্রমবর্ধমান।        

একদা রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় কেন্দ্র এবং বর্তমানে পশ্চিমা জোট ন্যাটোর সদস্য তুরস্কে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা এমন সময়ে করা হলো, যখন সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলো আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির গতি কমে আসায় অবরুদ্ধ অবস্থা শিথিল করতে শুরু করেছে।

তবে,  বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসাস সোমবার (২০ এপ্রিল) জেনিভায় সংস্থার সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'বিশ্বাস করুন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থার এখনও বাকি। আসুন একসঙ্গে সেই ট্রাজেডি ঠেকাই। এটা এমন একটা ভাইরাস, যা এখনও মানুষ বুঝতে পারছে না।'

উল্লেখ্য, বুধবারের (২২ এপ্রিল) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে এ পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে, আর সেরে উঠেছেন ৬ লাখ ৩৬ হাজার রোগী। মারা গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ।

এদিকে, তুরস্কে ক্রমবর্ধমান করোনার বিস্তৃতিতে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরিতিন কোকা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সঙ্কট নেমে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করলেও আশাবাদী ভাষায় জানিয়েছেন, তুরস্ক পশ্চিমের দেশগুলোর মতো স্বাস্থ্যসেবায়  সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বটে, কিন্তু পরিস্থিতি সামলানোর মতো প্রস্তুতি রয়েছে।

একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক হিসেবে তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোকা বেশ আগে থেকেই পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অবকাঠামো বিনির্মাণে কাজ করছেন। তুরস্কে বিদ্যমান সামর্থ্যের চেয়ে ৬০% ভাগ আইসিইউ বাড়ানো হয়েছে। কোকা প্রতিদিনই করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করছেন ও সরকারের কাজের বিষয়ে জনগণকে জানাচ্ছেন। ফলে সোস্যাল মিডিয়াতে তার জনপ্রিয়তা তীব্রভাবে বেড়েছে এবং টুইটারে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ৪ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে।       

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, তুরস্কে করোনা বিস্তারের ঝুঁকির পেছনে প্রধান কারণ হলো লকডাউন ও সামাজিক সঙ্গরোধের ক্ষেত্রে  দেশটির বিলম্বিত পদক্ষেপ। কেবল গত ১০ এপ্রিল থেকে তুরস্ক উইকঅ্যান্ড কারফিউ জারির আদেশ দিয়েছে। যদিও তুরস্কে স্কুল, মার্কেট বন্ধ রয়েছে, তথাপি দেশটি সর্বাত্মক লকডাউনে যেতে আগ্রহী নয়।

তুরস্ক সরকারের ভেতরে এ ব্যাপারে মতপার্থক্যের কারণে ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক মন্ত্রী সোলাইমান সাইলো পদত্যাগ করলেও প্রেসিডেন্ট রিকেপ তাইয়েপ এরদুগান তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদুগান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপচারিতায় মতপার্থক্য ভুলে বৈশ্বিক মহামারি করোনার বিরুদ্ধে একযোগে নিবিড়ভাবে কাজ করারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।   

সবচেয়ে বড় যে বিপদটি করোনা বিস্তারের ক্ষেত্রে  মাথাচাড়া দিয়েছে, তা হলো  তুরস্কের ভেতরকার রাজনীতিক দ্বন্দ্ব । করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কাজে প্রেসিডেন্ট এরদুগানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে লড়তে হচ্ছে দেশের পৌর প্রশাসনের সঙ্গে। কারণ, তুরস্কের দু'টি প্রধান শহর, রাজধানী আনকার ও ইস্তাম্বুল পৌর প্রশাসনের নেতৃত্বে আছে সরকার বিরোধী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি), যারা সরকারি পদক্ষেপের কঠোর সমালোচক।

মতপার্থক্যের বিষয়টি জানিয়ে  ইস্তাম্বুল থেকে 'ফরেন পলিসি'র গবেষক টেসা ফক্স এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট এরদুগান ও ইস্তাম্বুলের মেয়র ইকরাম ইমামুগলু দ্বান্দ্বিক অবস্থানে থাকায় সরকারি সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। ইকরাম গত দুই দফায় এরদুগানের রাজনৈতিক সংগঠন একেপি'র প্রার্থীকে পরাজিত করে ইস্তাম্বুলের রাজনীতি কব্জা করে রেখেছেন।

'যে বা যিনি ইস্তাম্বুলে কর্তৃত্ব করবেন, তুরস্কের রাজনীতিতে তার দৃঢ় অবস্থান হবে', জানিয়ে টেসা ফক্স মন্তব্য করেন, 'এরদুগান নিজেও ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে সফলতার হাত ধরে তুরস্কের মূল রাজনীতিকে এসেছেন।' 

অন্যদিকে, তুরস্কের অর্থনীতি আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় আছে, করোনার আঘাতে তা আরো বিপর্যস্ত হবে। ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রার মান কমে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছেছে।

'ফরেন পলিসি'র গবেষক আইকান এরডেমির ও জন এ লেচনার এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এরদুগান ও তার জামাতা, যিনি দেশের অর্থমন্ত্রী, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেন, তবে তুরস্কের আর্থিক ধস থামানো সম্ভব হবেনা। অতীতের ভুল পথে চললে তুরস্কের অর্থনীতি উঠে দাঁড়াবে না এবং করোনার কারণে যে আর্থিক মন্দা ও  জনস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, তাও সামলাতে পারবেনা। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর