বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর বিশ্ব

, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম    | 2023-09-01 23:34:01

কাগজে-কলমে বর্ণবাদের অবসান হলেও বাস্তবে তা হয়নি। পৃথিবীতে এখন আর বর্ণবাদ নেই, এমনটি কোনো কোনো ব্যক্তি বা মহলের  পক্ষে মনে করা হলেও তা যে কার্যক্ষেত্রে সঠিক নয়, আমেরিকার ঘটনা সে প্রমাণবহ। মে মাসের শেষ সপ্তাহে কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ কর্তৃক হত্যার পর বিশ্বের সামনে সুপ্ত বর্ণবাদী চেহারা আরেকবার উন্মোচিত হলো। এই ঘটনার অকুস্থল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র  ছাড়াও বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় বইছে বর্ণবাদের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে। 

করোনাভাইরাসের কারণে বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মানুষ এই বর্ণবাদী হত্যার বিরুদ্ধে ঘরের বাইরে চলে এসেছেন। উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের প্রায়- সকল দেশই প্রতিবাদ মুখর।

বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদের ক্ষেত্রে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ অধিকতর সরব। কারণ, পৃথিবীর উত্তরাংশ শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এবং উপনিবেশিকতার মাধ্যমে আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকায় বর্ণবাদ বিস্তারের জন্য দায়ী। তারাই বর্ণবাদের উদ্ভাবক।

ইউরোপের প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ছাড়াও ডাচ, ওলন্দাজ, দিনেমারের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দেশও বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। যেসব দেশ তারা দখল করে কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপন করেছে, সেখানেই মানুষকে বিভাজন করেছে। প্রথমত বর্ণ, রক্ত, গোষ্ঠী, অঞ্চলের নামে। পরে ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির নামে।

এইসব বিভাজন, যা বর্ণবাদী মনোভাব থেকে উৎসারিত, তা দখলকারী শক্তিকে দখল দীর্ঘস্থায়ীভাবে কায়েম করে শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নে সাহায্য করেছে। এই কথার দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ আফ্রিকা, ভারতবর্ষ কিংবা লাতিন আমেরিকার উপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসে পাওয়া যাবে, যা বিশ্বব্যাপী সত্য। 

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো এটাই যে, কয়েক শতাব্দী পরেও বর্ণবাদী নির্যাতনের রক্তমাখা অতীত বদলায়নি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বর্গভূমি খোদ আমেরিকাতেও বদলায়নি, যা জর্জ ফ্লয়েডকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রকাশিত। আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপের দেশে দেশে প্রায়ই বর্ণবাদী হামলার ঘটনার বিবরণ শুনতে পাওয়া যায়। শ্বেতাঙ্গদের আচরণ ও মানসিকতায় বর্ণবাদী উন্নাসিকতার এন্তার অভিযোগও শোনা যায়।

ফলে আইন বা সংবিধানের আওতায় বিলোপ হলেও মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও বর্ণবাদের প্রচ্ছন্ন ছাপ বিদ্যমান। শ্বেতাঙ্গদের সংস্কৃতিতে বর্ণবাদের অবসান হয়নি। সুযোগ পেলে অন্যকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করা এবং মওকা এলে হত্যা পর্যন্ত করতে কুণ্ঠিত নয় অনেক তথাকথিত আধুনিক সাদা মানুষ।

কারণ বর্ণবাদ আইন করে ধুয়েমুছে দেওয়ার বিষয় নয়, তা হলো এমন এক জঘন্য ও নিকৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ, যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বা 'রেস'-এ বিভক্ত এবং একই সাথে বিশ্বাস করা হয়, কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য।

এমনই উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বর্ণবাদের সঠিক ও একটিমাত্র  সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ, গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী বা রেস  ধারণাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এছাড়াও কোনটি বৈষম্য এবং কোনটি বৈষম্য নয় সেটি নিয়েও সবাই একমত নয়। বর্ণবাদ কখনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ বা কাস্ট দিয়ে হতে পারে।

সামাজিক বিজ্ঞানের কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ।

১৯৩০ সালে প্রথম বর্ণবাদ শব্দের উৎপত্তি হয় এবং ১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক স্লোগানে এই শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। তবে শব্দটির সাথে জড়িত যে নীতি তার উদ্ভব আরও আগে। ১৬৫২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বসতি স্থাপন শুরুর সাথে সাথে এই নীতির প্রচলন শুরু হয়।

১৬৫২ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ টাউন শহর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেপ কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল বর্ণগত বিভাজনের ভিত্তিতে। পরে ১৭৯৫ সালে  ব্রিটিশরা কেপ কলোনি দখল করে নেয়।

ব্রিটিশরা মূলত আমেরিকার পথে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার বিরতির জন্য বিশ্রাম ও দাস ব্যবসার উদ্দেশ্যে এ এলাকা দখল করে এবং স্থায়ীভাবে বসতিতে উৎসাহ পায়। কেপ কলোনিতে বুয়রাও থাকত। বুয়র শব্দটা ডাচ, যার মানে চাষি। তারা কথা বলত আফ্রিকানা ভাষায়, ডাচ ও জার্মানিক ভাষা মিলে আফ্রিকান্স ভাষা  তৈরি হয়েছিল। পরে তারা কেপ কলোনি থেকে ব্রিটিশদের চাপে চলে যায় ও দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে একটি বুয়র রিপাবলিক গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

১৮৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে হীরক ও ১৮৮৪ সালে স্বর্ণ পাওয়া যায়। এসব মূল্যবান সম্পদের সন্ধানে বহিরাগত-দখলদারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর কিছুকাল পরে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ব্রিটিশ শাসকশ্রেণী ও ডাচ-বুয়র দের মধ্যে লড়াই আরম্ভ হয়। ফলে বিভিন্ন বর্ণের রাজনৈতিক দল গঠিত হয় (যেমন, সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি ও  কালোদের আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস।

১৯৪৮ সালের নির্বাচনে সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি জয়ী হয়। তারপর থেকে শ্বেতকায় শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে অশ্বেতাঙ্গদের। এর ফলে যে নীতি নিতে হয়, তাই 'আপার্টহাইট' বা বর্ণবৈষম্য নীতি। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাদা, কালো, বর্ণময় বা কালারড ও ইন্ডিয়ান-এই চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হয় তীব্র অমানবিক বর্ণবাদী নীতিতে। ম্যান্ডেলার সাহসিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে কালো ও নিবর্তনমূলক অধ্যায়ের অবসান ঘটে।

আফ্রিকায় সর্বশেষ বর্ণবাদী সরকারের অবসানের আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে অফিসিয়ালি বর্ণবাদের অবসান হয়। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মানুষ ও তাদের সমাজ বর্ণবাদী আচরণ ও মানসিকতা লালন করতে থাকে।  

নিজেদের তথাকথত সভ্য দাবি করা আমেরিকানরাও বর্ণবাদের বাইরে আসতে পারেনা। অথচ সেদেশের ইতিহাসে ইউরোপীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চারশো বছর ধরে চলা রেড ইন্ডিয়ানদের অস্তিত্ব ও মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ের বিবরণ আছে। তাদের সুদীর্ঘকাল ধরে চলা সংগ্রাম অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। উন্ডেড নী পর্বতের পাদদেশে তাদের দীর্ঘ এ সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে।

রেড ইন্ডিয়ানদের এ করুণ পরিনতি নিয়ে ডি ব্রাউন লিখে গেছেন তার বিখ্যাত বই "বারি মাই হার্ট এট উন্ডেড নী"। মুভিও তৈরি হয়েছে একই নামে। বইটার বাংলা অনুবাদ 'আমারে কবর দিও হাঁটুভাঙার বাঁকে'।জর্জ ফ্লয়েডের 'আই কান্ট ব্রিদ' যেন বংশ পরম্পরায় রেড ইন্ডিয়ানদেরই বুকফাটা আর্তনাদের ধ্বনি সকরুণ আবহে মনে করিয়ে দিচ্ছে নির্মম অতীতকে। আর যেজন্য বিশ্বের দেশে দেশে এই করোনা কবলিত সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও মানুষ উত্তাপ প্রতিবাদ করছে কুৎসিত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর বিশ্ব জানাচ্ছে, বর্ণবাদের জঘন্যতম অতীতের পুনরাবৃত্তি কেউ মেনে নেবে না। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর