দেশে কন্যাশিশুদের ওপর যৌন সহিংসতা বেড়েছে ভয়ঙ্কর মাত্রায়। খুব সহজে যৌন হিংসার বলি হচ্ছে তারা। বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন কারণে শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা বাড়ছে। ধর্ষণ-গণধর্ষণ শেষে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে অধিকাংশের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। এসব বর্বর ঘটনা সবিস্তারে বলা সম্ভব নয়। এক কথায়, সমাজে কন্যাশিশুরা মারাত্মক অবহেলার শিকার। এর প্রমাণ হলো, ডাস্টবিনসহ রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের মধ্যে অধিকাংশই কন্যাশিশু। এতেই স্পষ্ট বুঝা যায়, কন্যাশিশুদের প্রতি সমাজে কি পরিমাণ বৈষম্য রয়েছে। অথচ এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না। এই কন্যা সন্তানরা হলেন আল্লাহতায়ালার রহমত বিশেষ।
আমরা জানি, আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুই ভাগে সৃষ্টি করেছেন- পুরুষ আর নারী। আল্লাহতায়ালা কাউকে শুধু কন্যা সন্তান দান করেন, কাউকে পুত্র সন্তান। কাউকে আবার পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন। কাউকে কাউকে আবার কোনো সন্তানই দান করেন না। এটা আল্লাহতায়ালার বিশেষ হিকমত ও কল্যাণ জ্ঞানের ভিত্তিতে হয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা করে দেন বন্ধ্যা।’ -সূরা শুরা: ৪৯-৫০
কন্যা সন্তানও আল্লাহর নিয়ামত, পুত্র সন্তানও তদ্রুপ। কন্যা সন্তানেরও প্রয়োজন আছে, পুত্র সন্তানেরও প্রয়োজন আছে। পুরুষ নারীর মুখাপেক্ষী, নারী পুরুষের মুখাপেক্ষী। এটাই দুনিয়ার রীতি ও আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতে দেওয়া জীবনব্যবস্থা।
মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষ মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট হয়। এটাকে অপমানের কারণ মনে করে। অথচ কোনো মুমিনের জন্য এমন কাজ ও মনোভাব সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এটা গোনাহের কারণও বটে। এমন চিন্তা আল্লাহতায়ালা হিকমত ও কল্যাণ জ্ঞানের ওপর আপত্তি করার নামান্তর। কোরআনে কারিমে এ কাজকে কাফেরদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামপূর্ব জাহেলি আরবে নিয়ম ছিল, যদি তাদের কন্যা জন্মলাভ করত, তাহলে এটাকে তারা নিজের জন্য অমঙ্গল ও অপমানের কারণ মনে করত। আল্লাহতায়ালা সূরায়ে নাহলে তাদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তাদের মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখো, তাদের ফায়সালা খুবই নিকৃষ্ট।’ -সূরা নাহল: ৫৮-৫৯
লক্ষ্য করুন, কোরআনের আয়াতে কিন্তু কন্যা সন্তানের জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলা হচ্ছে। এটাকে যারা কষ্টের কারণ মনে করে, তাদের জাহেলি কর্মকাণ্ড ও মানসিকতার শুধু নিন্দাই করা হয়নি বরং তারা যেটাকে দুঃসংবাদ মনে করছে সেটাকে ব্যক্ত করা হয়েছে ‘সুসংবাদ’ বলে। সেই সঙ্গে মুমিনদের মাঝে যেন এমন জাহেলি মানসিকতার লেশমাত্র না থাকে, সেজন্য আয়াতের শেষে বলা হয়েছে; লক্ষ্য করো, সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল।
ইসলামের শিক্ষা হলো, কন্যা সন্তান হলে কোনোরূপ অসন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। মুসলমানদের এমন মনোভাব ও কাজ পরিহার করতে হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমনিভাবে কন্যা সন্তান হওয়াকে আল্লাহর রহমত বলেছেন এবং কন্যা সন্তানের সঙ্গে তিনি যে ভালোবাসা ও স্নেহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন- এসব আমাদের জন্য আদর্শ। আমাদের উচিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা। তার কর্মপন্থা মেনে চলা। তিনি নিজ কন্যাদের সঙ্গে অত্যন্ত মহব্বত ও স্নেহের আচরণ করতেন। তার চারজন কন্যা সন্তান ছিল। হজরত ফাতেমা (রা.), হজরত জয়নব (রা.), হজরত রুকাইয়া (রা.) ও হজরত উম্মে কুলসুম (রা.)। রাসূলের জীবদ্দশায় তিন মেয়ের ইন্তিকাল হয়, হজরত ফাতেমা (রা.)-এর ইন্তেকাল হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পরে হয়।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফরে যেতেন, সবশেষে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করে যেতেন। আবার যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন, সর্বপ্রথম হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করতেন। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের আমলের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের সম্মান, তাদের প্রতি স্নেহ ও মহব্বতের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেন আমরাও তার অনুসরণের মাধ্যমে নিজের কন্যা সন্তানের সঙ্গে তেমন আচরণ করতে পারি।
কন্যা সন্তানের লালন-পালন জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যা সন্তানের লালন-পালনের যে পরিমাণ ফজিলতের কথা বলেছেন, পুত্র সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ বলেননি। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে। আর সে তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেছে, তাদেরকে নিজের জন্য অসম্মানের কারণ মনে করেনি; সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ -জামে তিরমিজি: ১৯১২
অন্য হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে অথবা দু’জন কন্যা সন্তান বা বোন আছে। সে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালাকে ভয় করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’ -জামে তিরমিজি: ১৯১৬
দেখুন, এ ফজিলতের কথা পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে বলা হয়নি। বরং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছেভ এ জন্য আমাদের উচিত কন্যা সন্তানের লালন-পালন সন্তুষ্টচিত্তে করা।
কন্যা সন্তান জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় হবে।’ -জামে তিরমিজি: ১৯১৩
কন্যা সন্তান প্রতিপালনের তিনটি ফজিলত। এসব ফজিলতের সারমর্ম হলো- তিনটি জিনিস।
এক. আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।
দুই. জান্নাত দান করবেন। যা নিয়ামত ও আরাম-আয়েশের স্থান।
তিন. আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য দান করবেন। যা সফলতার সর্বোচ্চ চূড়া।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ তিনটি ফজিলত বর্ণনা করেছেন কন্যা সন্তান লালন-পালনকারীদের জন্য। হাদিসে বর্ণিত এসব ফজিলত পেতে হলে, কন্যা সন্তানের জন্মে অধিক আনন্দ প্রকাশ করতে হবে। কারণ, কোরআনে কন্যা জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কন্যা সন্তানদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে তাদের হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। তাদের প্রতি কোনো ধরনের অবহেলা প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করতে হবে। অনেকে ছেলেকে বেশি বেশি খাওয়ায়, বেশি বেশি ঘুরতে নিয়ে যায়। আর মেয়েকে জিজ্ঞাসাও করে না। এভাবে মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে কমবেশি করে, এটা অনুচিত। কখনও মা-বাবা কথায় ও কাজে এমন ভাব প্রকাশ করবে না, যাতে সন্তানরা বুঝতে পারে, মা-বাবা অমুককে বেশি ভালোবাসেন, অমুককে কম ভালোবাসেন। যদি মা-বাবা এমনটা করেন তাহলে তা হবে অন্যায় এবং কিয়ামতের দিন এর জন্য পাকড়াও করা হবে।