মানবতার সেবায় আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন একটি আলোকিত নাম

বিবিধ, ইসলাম

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম | 2023-09-01 14:42:59

চারদিকে ঘন বন। অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাহাড়ী লালমাটি। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া চাকফিরানী এলাকার এমন পরিবেশে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে কুয়েত আদর্শ পল্লী। পল্লীতে গৃহহীন স্থানীয় ২৫টি পরিবারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সেমিপাকা ভবন। একটি পরিবারের বসবাসের জন্য যা যা দরকার তার সবই রয়েছে পল্লীতে। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে গৃহহীনদের। এভাবে শুধু উপজেলার বড়হাতিয়া চাকফিরানী নয়, সাতকানিয়ার চরতি ও মাদার্শা এলাকাতেও গৃহহীনদের জন্য আরও ২টি পল্লী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

শুধু দরিদ্রদের জন্য এমন পল্লী নয়, বিগত ২০ বৎসর ধরে দেশের শীর্ষস্থানীয় এনজিও সংস্থা আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন দেশের আনাচে-কানাচে মসজিদ, একাডেমিক ভবন, গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন, ইফতার সামগ্রী বিতরণ, কোরবানির গোশত বিতরণ, চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা বৃত্তিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সাম্প্র্রতিক সময়ে দুস্থ, নিরন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত ও কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত গণমানুষের সেবায় আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখদের ব্যবস্থাপনায় যে সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, তা বাংলাদেশের মানবতা ও সমাজসেবার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাদের ব্যাপক সেবাকার্যক্রম জনগণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, আস্থা ও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এসব সেবা সংস্থার মধ্যে যাদের তৎপরতা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে তার অন্যতম হলো- আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন।

বড়হাতিয়া চাকফিরানিতে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্মিত আদর্শ পল্লী, ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সংসদ সদস্য মাওলানা ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী কর্তৃক ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়- আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন। তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি ইতোমধ্যে মানবিক সেবাকার্যক্রমে দেশবাসীর নজর কেড়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত এই সংগঠন সৌদি আরব, কুয়েত, ওআইসি, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়ারসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় করে মানবিক সেবাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশ, জাতি, ধর্ম ও মানবতার সেবায় শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব অর্জনের লক্ষে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনটি ২০০০ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন (২৩১৬/২০০০) পায়। একই বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ এনজিও বিষয়ক ব্যুরোরও নিবন্ধন (১৭৭০/২০০২) লাভ করে।

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, বিগত দু’বছরে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তিন হাজার পরিবারে কোরবানির গোশত, ১০ হাজার পরিবারে ইফতার সামগ্রী, ৫০ হাজার পরিবারে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ২০০টি গভীর নলকূপ, ৫০০টি অগভীর নলকূপ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অজুখানাসহ ৩০টি মসজিদ, আমিরাত পল্লী, কুয়েত পল্লী, কাতার পল্লী, ওআইসি পল্লী নির্মাণের মাধ্যমে ২২৯ গৃহহীন পরিবারকে আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমিরাত ও ওআইসি পল্লী নির্মাণ করা হয়েছে বাগেরহাট ও মাদারীপুরের সিডর উপদ্রুত এলাকায়। প্রতিটি পল্লীতে রয়েছে পরিবারের জন্য বাড়ি, স্যানিটারি ব্যবস্থা, মেডিক্যাল সেন্টার, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারা বিগত দু’বছরে ২০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করেছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ হাজার অস্থায়ী ঘর, ৩০০টি টয়লেট, ৫৬০টি সোলার লাইট স্থাপন করেছে।

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী

সংসদ সদস্য ছাড়াও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর পরিচয় হলো- তিনি বাংলাদেশের একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাধর অনন্য খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যক্তিত্ব। সুলেখক ও আরবি সাহিত্যিক। তিনি নিরলসভাবে দেশ, জাতি ও দ্বীনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা হতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ভারতের লাখনৌতে অবস্থিত নদওয়াতুল উলামায় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। সেখানে তিনি জগৎবিখ্যাত আলেম সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তার চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে এম. এ সম্পন্ন করেন এবং লাখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

১৯৮৯ সালে জামেয়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে প্রফেসর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকীকরণ, এর অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি টানা দুই বার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ইসলামি স্কলার হিসেবে তিনি মুসলিম বিশ্বে বেশ সমাদৃত। তার গবেষণালব্ধ লেখনি তাকে মুসলিম বিশ্বের অনন্য উচ্চতার আসনে সমাসীন করেছে। তিনি ফিকাহ, বিজ্ঞান এবং আরবি সাহিত্যে খুবই দক্ষ।

মানবসেবার নিমিত্তে পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সেবা সংস্থা আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে সমাজসেবামূলক কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানার আমতলীতে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্মিত আদর্শ পল্লী, ছবি: সংগৃহীত

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন প্রসঙ্গে আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী এমপি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এই ফাউন্ডেশনটি নিঃস্বার্থভাবে মানবতার সেবায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমরা এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭০০ মসজিদ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০টি ভবন, চার হাজার গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন, বিভিন্ন মসজিদের ৯শ’ অজুখানা নির্মাণ, গরীব ও অসহায়দের জন্য ২৫০টি ঘর, ৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্লিনিক নির্মাণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত গৃহহীন মানুষের জন্য ৫টি পূনর্বাসন পল্লী করেছি। ৭শ’ এতিমের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছি। বিভিন্ন স্থানে কোরআন শিক্ষা ব্যবস্থাসহ মিয়ানমার হতে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর নির্মাণ ও অন্যান্য সামগ্রী প্রদান করেছি। করোনাকালে আলেম-উলামাসহ অসহায়দের মাঝে নগদ ২৫ লাখ টাকা বিতরণ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ২০টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে ব্যাটারি চালিত গাড়ি, ২৫০টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে সেলাই মেশিন, ৫০টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে ঠেলা গাড়ি বিতরণ করেছি। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারের মাঝে পার্সেল খাবার, ঘর নির্মাণের সরঞ্জামাদি, ক্ষতিগ্রস্থের মাঝে জরুরি ত্রাণ, ছিন্নমূল ও গরীবের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, প্রতিবছর রোজাদারদের মাঝে ইফতার সামগ্রী এবং গরীবদের মাঝে কোরবানির গোশত বিতরণ করে থাকি।’

সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে নির্মিত মসজিদ, ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন থেকে গবেষণালব্ধ বিভিন্ন পুস্তকাদি প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে গরীব শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ, অভাবী পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-শাদীতে সাহায্য প্রদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ও এতিম-দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, শিক্ষা ও গবেষণায় সহযোগিতা প্রদান, আলেম-উলামা, ইমাম, খতিব ও মাদরাসার ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন কোর্স ও কর্মশালার আয়োজন করে তাদেরকে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন করা হয়।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর