নাগার্নো-কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুশা দখলের মধ্য দিয়ে প্রায় দেড় মাসের লড়াইয়ে বড় ধরণের কৌশলগত জয় পেলো আজারবাইজান। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এই তথ্য জানিয়েছেন। অবশ্য আর্মেনিয়ান কর্তৃপক্ষ এই দাবিকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে।
রোববার (৮ নভেম্বর) আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেন, ‘গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, শুশা শহর এখন আমাদের দখলে। ৮ নভেম্বর আজেরি জনগণের ইতিহাসে এক বিশেষ দিন হতে যাচ্ছে।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘২৮ বছর পর আবারও শুশা শহরে আজানের ধ্বনি শোনা যাবে।’
আজারবাইজানের সেনাবাহিনীর জন্য শুশা শহর পূনর্দখল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া যুদ্ধে এটা অন্যতম বড় জয় হিসেবে দেখছে আজারবাইজান।
ভৌগোলিক কারণে শুশা শহরটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি আর্মেনিয়দের দখলে থাকা নাগার্নো-কারাবাখের রাজধানী স্টেপনোকার্ট (খানাকেন্দি) থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এছাড়া শুশা শহরের ভেতর দিয়েই মূল আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র সড়ক অবস্থিত।
গত সপ্তাহে নাগার্নো-কারাবাখের এক দখলদার আর্মেনিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আজারবাইজানের সেনাবাহিনী শুশা শহর দখলের কাছাকাছি।’
শুশা শহরের প্রসিদ্ধ ক্যাথিড্রালে আরায়িক হারুতইয়ুনইয়ান বলেন, ‘শহর থেকে শত্রুরা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তাদের উদ্দেশ্য শুশা দখল করা। কেননা শুশা যাদের দখলে থাকবে, তারাই কারাবাখের নেতৃত্বে থাকবে।’
এ সময় তিনি কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর শুশা রক্ষার্থে আর্মেনিয়দের এগিয়ে আসারও আহবান জানিয়েছিলেন।
আজারবাইজান এশিয়া মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। বন্দর নগরী বাকু আজারবাইজানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইউরোশিয়া অঞ্চলের এশীয় দেশ আজারবাইজানের আয়তন ৮৬ হাজার ৬৬০ বর্গকিলোমিটার। আজারবাইজানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে আর্মেনীয় অধ্যুষিত এলাকা নগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে দু’দেশের বিতর্ক বহু দিনের, সেটাকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধ চলমান।
১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ভেঙে আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ায় নামে তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তখন থেকেই আজারবাইজান ও আর্মেনীয়দের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা লাভ করলে এই দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়।
আজারবাইজানের ১০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশ মুসলিম। হিজরি প্রথম শতকে আজারবাইজানে ইসলামের আগমন ঘটে। রাজনীতির নানা বাঁক পেরিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির পর রুশ সরকার আজারবাইজান থেকে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য মিটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সব ধরনের ধর্মচর্চার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রুশ শাসনামলে আজারবাইজানে মসজিদের সংখ্যা দুই হাজার থেকে মাত্র ১৬-তে নেমে আসে। তবে স্বাধীনতার পর তা আবার বাড়তে থাকে। বর্তমানে আজারবাইজানে ১ হাজার ৮০০ মসজিদ রয়েছে।
১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আজারবাইজান। আজারবাইজানের তরুণ প্রজন্ম ইসলামপরায়ণ। স্বাধীনতার সময় আজারবাইজানে মাত্র একটি ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও ২০০০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০। তন্মধ্যে সরকার অনুমোদিত মাদরাসা রয়েছে ৩০টি।
বাকুতে অবস্থিত মাদরাসাটিকে ১৯৯২ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। সম্প্রতি সরকার সাতটি ইসলামিক কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে চলতি বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
এমন প্রেক্ষাপটে শুশা দখল এবং আজান চালুর ঘোষণাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ পর আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক বলেছে, এই লড়াইয়ে তারা আজারবাইজানকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে।
অন্যদিকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। সেদেশে রয়েছে তাদের সামরিক ঘাঁটিও। আবার আজারবাইজানের সঙ্গেও মস্কোর সম্পর্ক ভালো। তাই রাশিয়া চুপ। ফলে আর্মেনিয়া যুদ্ধে পিছিয়ে আছে। তা ছাড়া ওই অঞ্চলে রাশিয়ার নীতি হচ্ছে, শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করা।