শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে: ঢাকা-মৌলভীবাজার মহাসড়ক থেকে ভৈরবগঞ্জ বাজার হয়ে বরুণা যাওয়ার রাস্তায় চলার সময় চোখে পড়ে সচেতনতামূলক বেশ কিছু সাইনবোর্ড। এসব সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘কোরআন পড়ুন, কোরআন বুঝুন’, ‘তিন বস্তু মানুষকে ধ্বংস করে- লোভ, হিংসা ও অহংকার,’ ‘মুমিন ব্যক্তি কখনও মৃত্যুকে ভুলতে পারে না,’ ‘আল্লাহর জিকিরে আত্মায় প্রশান্তি আসে,’ ‘গোনাহ থেকে নিজে বাঁচুন এবং অন্যকে বাঁচান,’ ‘সর্বোত্তম সদকা হলো- কোনো ক্ষুধার্তকে পেট ভরে খাওয়ানো,’ ‘নামাজ কায়েম করুন।’
আবার কোনো কোনো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘কোরআন পড়ুন, কোরআন বুঝুন, আল কোরআনের সমাজ গড়ুন,’ ‘সুদ-ঘুষসহ যেকোনো গোনাহ থেকে বেঁচে থাকুন,’ ‘হ্যালো নয়, সালাম দেওয়ার অভ্যাস করুন,’ ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সবচেয়ে বড়,’ ‘সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ সবচেয়ে পবিত্র’ ও ‘আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।’
রাস্তার পাশে এভাবে সাইনবোর্ড দিয়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর কথা স্মরণ, গোনাহমুক্ত জীবন গঠন, ভালো কাজে আগ্রহী ও সচেতন করা হয়েছে। সাইনবোর্ডগুলো মৌলভীবাজারের ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরুণা মাদরাসার সৌজন্যে লাগানো হয়েছে।
বরুণা মাদরাসার নায়েবে সদরে মুহতামিম মাওলানা শেখ নুরে আলম হামিদী ১৯৯২ সালে এসব সাইনবোর্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ওই বছর হজব্রত পালনের পর মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে বিভিন্ন হাদিস লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড দেখে তিনি এ কাজে আগ্রহী হন। এর পর বাংলাদেশে ফিরে তিনি এসব সাইনবোর্ড স্থাপন করেন।
সমাজের কল্যাণ চিন্তা আর পরিবেশের কথা মাথায় রেখে গাছের সঙ্গে পেরেক পুঁতে সাইনবোর্ডগুলো না লাগিয়ে লোহার খুটিতে, লোহার পাতে লেখা হয়েছে।
বরুণা থেকে শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার যাতায়াতকারী মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, ‘প্রায়ই এ রাস্তা দিয়ে তিনি চলাচল করেন। রাস্তায় লিখিত এসব সাইনবোর্ড আল্লাহর নাম স্মরণসহ মনে বিভিন্ন ভালো কাজের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। এমনকি, পথে চলার সময় নানা ধরনের দুচিন্তা মাথায় থাকলেও এগুলো দেখে মন ভালো হয়ে যায়।’
বরুণা গ্রামের বাসিন্দা কলেজ ছাত্র মো. সোহাগ বলেন, ‘এসব সাইনবোর্ড মানুষকে সচেতন করছে। সমাজকে ভালো রাখতে, মানুষকে সচেতন করতে এটা একটি চমৎকার পদ্ধতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের অন্যরাও এমন সচেতনতামূলক কাজে এগিয়ে এলে, একদিন আমাদের এই সমাজ উন্নত সমাজে পরিণত হবে।’
শায়খুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর খলিফা, বরেণ্য বুজুর্গ, শায়খ লুৎফুর রহমান বর্ণভী (রহ.) ১৯৪১ সালে বরুণা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা ছাড়াও মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের জামেয়া লুৎফিয়া আনোয়ারুল উলুম হামিদনগর বরুণা মাদরাসাটি সমাজ কল্যাণমূলক নানা কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বহুমুখী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে খ্যাতি লাভ করেছে।
বরুণা মাদরাসার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে মসজিদে আবু বকর। এখানে একসঙ্গে ৭ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এত বড় মসজিদ সিলেট বিভাগে আর নেই। প্রতি বছর বরুণা মাদরাসার বার্ষিক সম্মেলনে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।
বরুণা মাদরাসায় দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস অনুসরণে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা ও ইলেকট্রিকসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এই মাদরাসার তত্বাবধানে একটি মহিলা মাদরাসাও পরিচালিত হয়। দুই প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। কওমি মাদরাসার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় বেশ কয়েক বছর ধরে সিলেট বিভাগের মধ্যে সেরা ফলাফল অর্জন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
দ্বীনি এই প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক উন্নয়ন ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। এই মাদরাসার উদ্যোগে সমাজের গরিব ও দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণের পাশাপাশি টিউবওয়েল, সেলাই মেশিন ও প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ার বিতরণ করা হয়।
বর্তমানে বরুণা মাদরাসার সদরে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা শায়খ সাইদুর রহমান বর্ণভী। আর নায়েবে সদরে মুহতামিম হলেন মাওলানা শেখ নুরে আলম হামিদী ও প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন- মাওলানা শেখ বদরুল আলম হামিদী।
উল্লেখ্য, ইসলামের বাণী লিখিত এমন সাইনবোর্ড বিভিন্ন উন্নত দেশে নিয়মিতই দেখা যায়। এসব সাইনবোর্ড দর্শকদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর কথা, পাপমুক্ত জীবন ও কল্যাণমূলক সমাজ গঠনের কথা। এর মাধ্যমে ইসলামের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। মন ও পরিবেশ পরিবর্তনের উপলক্ষ্য তৈরি হয়।