তাইওয়ান মাত্র ১৩ হাজার ৮২৬ বর্গমাইলের একটা দ্বীপ। চীন মনে করে তাইওয়ান তাদের ভৌগলিক সংহতির ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন হংকংয়ের যেকোনো বিষয়কে চীন তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মনে করে। কিন্তু তাইওয়ান মনে করে তারা চীন থেকে আলাদা। দেশটির জনগণের একটি অংশ স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে। তাইওয়ান-চীন দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো হলেও এটা সত্য যে, তাইওয়ান চীনের শাসনের অধীন ছিল। ১৬২৪ হতে ১৬৬১ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য তাইওয়ান ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ। এরপর আবার চীন তাইওয়ানের দখল ফিরে পায়। সে ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। তবে একটি রাষ্ট্র বলে গণ্য হওয়ার জন্য যা যা দরকার, তার সবই তাইওয়ানের আছে। যেমন নিজস্ব ভূখণ্ড, জনগণ, নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ও তিন লাখ সৈন্যের সেনাবাহিনী।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ তাইওয়ান। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে না। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে তাইওয়ানের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে মাত্র ১৫টি দেশের। চীনের আপত্তি ও বাধায় তাইওয়ান জাতিসংঘেও নেই।
২ কোটি ৩৫ লাখ জনসংখ্যার তাইওয়ান বিশ্বের সমৃদ্ধ এক অস্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রের দাবিদার হয়েও সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত দেশ না হওয়ায়, নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য নানা রকম পথের সন্ধানে গণচৈনিক ভূখণ্ডে থাকতে হচ্ছে তাইওয়ানকে।
এমন রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাইওয়ানের ২ লাখ মুসলিম সামনে এগিয়ে চলেছেন। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম চীনে প্রবেশ করে। আর চীন থেকেই তাইওয়ানে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম। সাংবিধানিকভাবে তাইওয়ানে যে কোনো মানুষের ধর্ম অনুশীলন, চর্চা ও প্রচারে কোনো বাধা নেই। ইসলামের বিধি-বিধানের পূর্ণাঙ্গ ধারণা ও শিক্ষা তাইওয়ানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও প্রতিফলিত হয়নি। তবে তারা বংশপরম্পরায় ইসলামের বোধ ও বিশ্বাসকে লালন করে চলেছেন। সীমিত আকারে মুসলিম মেয়েরা পর্দা প্রথা মেনে চলে। মুসলমানদের স্বচ্ছ ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা, নৈতিক মূল্যবোধ, পারিবারিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক সাম্যের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাইওয়ানের সাধারণ মানুষ ইসলাম ইসলামকে ভালোবাসেন। পশ্চিমাদের অপপ্রচারের কারণে কিছু মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হলেও স্থানীয় মুসলমানদের ইতিবাচক চলাফেরা ও দাওয়াতি প্রচারের কারণে তা দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে। রাষ্ট্রীয় ভাষা মান্দারিন। তবে তাইওয়ানি ও হাক্কা ভাষা বেশ প্রচলিত। তাইওয়ানে সরকার স্বীকৃত ১৩টি ধর্ম রয়েছে। এর অন্যতম হলো- বৌদ্ধ, তাঈ, ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যন্ট, ইসলাম, লি-ইজম, বাহাই ও থেনকিকি। অর্ধেক জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
তাইওয়ানে মসজিদের সংখ্যা ৬টি। তবে বেশ কিছু নামাজ ঘর রয়েছে। তাঈপে গ্র্যান্ড মসজিদ হচ্ছে সবচেয়ে বড় মসজিদ। রাজধানী তাইপের দান জেলায় অবস্থিত এ মসজিদের আয়তন ২ হাজার ৭৪৭ বর্গমিটার। তাইপের নগর প্রশাসন ১৯৯৯ সালের ২৬ জুন এটিকে ঐতিহাসিক মসজিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
১৯৮০ সালের দিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিপুলসংখ্যক মুসলমান তাইওয়ানে পাড়ি জমায়। তাইওয়ানের বসবাসকারী স্থায়ী মুসলমানদের অর্ধেক নতুন ধর্মান্তরিত। ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। তারা ইসলাম কবুল করে মুসলমানদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে।
রাবেতা আল আলম ইসলামিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থার সঙ্গে তাইওয়ানের মুসলমানদের যোগাযোগ রয়েছে। প্রতি বছর ৩০-৩৫ জন মুসলমান হজ পালনের জন্য সৌদি আরব গমন করেন।
তাইপে গ্র্যান্ড মসজিদ তাইওয়ানের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা। আরবি ও পারস্য স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি এ মসজিদে ১ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ কম্পাউন্ডে রয়েছে ৪০০ আসনের মিলনায়তন, যেখানে সেমিনার, ওয়াজ মাহফিল ও সিরাত কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় নিয়মিত। নামাজ ও ইবাদতের পাশাপাশি তাইওয়ানের প্রতিটি মসজিদে বিশেষত সাপ্তাহিক বন্ধ ও সাধারণ ছুটির দিনে কোরআন ও ধর্মীয় তালিম চলে।
তাইপে গ্র্যান্ড মসজিদ তাইওয়ানের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক বিখ্যাত মসজিদ। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি ১৯৪৭ সালে নির্মিত হয়েছে এবং ১৯৬০ সালে সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদটি মুসলমানদের সঙ্গে সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক। এই মসজিদের অস্তিত্ব তাইওয়ান এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং তাদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসারিত করেছে। এই মসজিদের পরে তাইওয়ানে কাহোইসুং মসজিদ, তাইপে সংস্কৃতি মসজিদ এবং তাইচুং মসজিদের মতো অন্যান্য মসজিদগুলো নির্মিত হয়।
তাইপে মসজিদটি প্রথমে একতলা ছিল, পরবর্তীতে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করা হয় এবং দ্বিতীয় তলাটি নারী মুসল্লিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ঐতিহাসিক এই মসজিদের অধীনে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে।
১৯৬০ সালে স্থানীয় মুসলমান ও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের আর্থিক সহয়তায় নির্মিত তাইপে গ্র্যান্ড মসজিদ কাম ইসলামিক সেন্টার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মসজিদে কিশোর শিক্ষার্থীদের ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীর ওপর পাঠদান করা হয়। তাইওয়ানে মুসলমানদের মসজিদকেন্দ্রিক এক নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। এই সমাজ ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য হলো, সমাজের মুরব্বি শ্রেণিদের নেতৃত্ব। তাইওয়ানের মসজিদভিত্তিক বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে গঠিত কমিটি সর্বদা সতর্ক থাকে। তারা মুসলিমদের আত্মোন্নয়ন এবং নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি প্রয়োজনে অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকে- যাতে মুসলিম সমাজ কলুষিত না হয়। মুসলিম তরুণ-তরুণীরা শূকরের ও মাদকের প্রতি আসক্ত না হয়- সেজন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়।
তাইওয়ানে চীনা ও মান্দারিন ভাষা প্রচলিত। মা-জুন চীনা ভাষায় পবিত্র কোরআন এবং চেন কি লি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্বাচিত হাদিসগুলো তরজমা করেন। এছাড়া ছোটখাটো দ্বীনি পুস্তিকা চীনা ও মান্দারিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
দুই বছর আগে তাইওয়ানের পর্যটন বিষয়ক কার্যালয় মুসলিম পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ৫০টি হালাল রেস্টুরেন্ট চালু করেছে। এছাড়া প্রায় হোটেলেই হালাল খাবার আর নামাজ পড়ার জায়গা রাখা হচ্ছে। দেশটিতে চীনের পর্যটক কমতে থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে তাইওয়ানের পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তাইওয়ানের কিনম্যান কাউন্টি আইল্যান্ডে অবস্থিত ন্যাশনাল কিউমোয় ইউনিভার্সিটিতে (এনকিউইউ) মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কক্ষে নামাজের ব্যবস্থা করায়। মুসলিম শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতেই এমন উদ্যোগ। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ইন্দোনেশিয়ার কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে নামাজ আদায়ের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করতে তাইওয়ানের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পৃথকভাবে নামাজের সুব্যবস্থা করা হচ্ছে। নানা বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও দেশের উন্নতি, সম্প্রীতি রক্ষা আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে একযোগে কাজ করছে দেশের নাগরিকরা। এক্ষেত্রে মুসলমানদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি মুসলিমরা তাদের কর্মগুণ ও নিষ্ঠার কারণে গুরুত্ব পেয়ে আসছেন।