হাদিসে সুদ খাওয়াকে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংসাত্মক কাজ।’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ’ থেকে বেঁচে থেকো। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেই সাতটি বিষয় কী? বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, জাদু করা, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল খাওয়া, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা।’ –সহিহ বোখারি: ২৭৬৬
সুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আল্লাহর রাসূল অভিশাপ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত (অভিশাপ) করেছেন সুদগ্রহীতার ওপর ও সুদদাতার ওপর এবং এর দলিল লেখকের ওপর ও সাক্ষ্যদাতার ওপর। -সহিহ মুসলিম: ১৫৯৮
সমাজ ব্যবস্থার পতনের কারণে ভয়াবহ রকমের গোনাহের যে ব্যাপক বিস্তার ঘটে তার এক দৃষ্টান্ত সুদ। মুসলিম জনপদগুলোতেও এর চিত্র ভয়াবহ। এই ধ্বংসাত্মক ও অভিশাপের কাজটি ঘরে ঘরে বিস্তৃত হয়েছে।
প্রয়োজনের তাগিদে মানুষকে ব্যাংকে লেন-দেন করতে হয়। যারা সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে, তারা যথাসম্ভব সুদি কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কারণ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও- যদি তোমরা মুমিন হও। অতঃপর যদি তোমরা না করো, তাহলে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও।’ –সূরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯
সুদ সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের এমন নিষেধাজ্ঞার দরুন মুমিনরা সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু কখনও কখনও নিরুপায় হয়ে সুদভিত্তিক ব্যাংকের সহায়তা নিতে বাধ্য হয়। যেমন- সেলারি অ্যাকাউন্টের কথাই বলা চলে। সরকারি ও বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরাসরি হাতে হাতে দেওয়া হয় না। বরং ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সে জন্য কোনো ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে তার বেতন-ভাতা জমা দিয়ে দেয়। এরপর কর্মচারীরা ব্যাংকে গেলেই সবাই নিজ নিজ বেতন ওঠাতে পারে। এই অ্যাকাউন্ট যেহেতু সেভিংস অ্যাকাউন্ট হয়, ফলে ইচ্ছা না থাকলেও তাদের অ্যাকাউন্টে সুদের অর্থ চলে আসে।
এখানে চাকরিজীবীর কিছুই করার থাকে না। কোনো চাকরিজীবী এতে আপত্তি করলেও তার জন্য প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে ইসলামি কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে দেবে না। তারা সবার জন্য কোনো সুদি ব্যাংকে গ্রুপ অ্যাকাউন্ট করে রাখে। এখানে যেহেতু চাকরিজীবী বাধ্য। অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে তার কোনো ইচ্ছা কিংবা কর্তৃত্ব নেই, তাই ওই সেভিং অ্যাকাউন্ট তথা সেলারি অ্যাকাউন্ট খোলার গোনাহ চাকরিজীবীর ওপর আরোপ হবে না। এর সব দায় ও গোনাহ প্রতিষ্ঠানের হবে।
ধর্মপরায়ণ অনেক মুসলমানই বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন। এ পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় কী, তা অনেকেই জানেন না।
এখানে কর্মচারীদের করণীয় হলো, প্রতি মাসে সেলারি অ্যাকাউন্টে বেতনের অর্থ আসা মাত্র তা তুলে শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত কোনো ব্যাংকে রেখে দেওয়া। যদি নিজের কাজে ক্যাশ রাখার কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা থাকে সেটা আরও ভালো। কিন্তু এর পরও যদি বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে কোনো সুদ চলে আসে, তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সেই টাকা সুদদাতাকে ফেরত দিতে হবে।
কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেহেতু নির্দিষ্ট সুদদাতা বের করা অসম্ভব, তাই সওয়াবের নিয়ত না করে কোনো জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত মিসকিনকে তা দান করে দিতে হবে। -আহসানুল ফাতাওয়া: ৭/১৬
কোনো অবস্থাতেই সেই টাকা মসজিদ, মাদরাসা বা কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ (যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ) ইত্যাদিতে খরচ না করা। -ইমদাদুল মুফতিন: ৫৮৬
মুসলমানের প্রথম কর্তব্য, সুদকে হারাম জেনে তা বর্জনে সংকল্পবদ্ধ হওয়া। তাহলে অবশ্যই উপার্জনের হালাল উপায় বের হয়ে আসবে। এটা ঠিক যে, সমাজে অসততার বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরপরও হালাল উপার্জনের পথ একেবারে রুদ্ধ নয়। এই অসততা ও নৈরাজ্যের বিস্তারও ইসলামি নীতি ও বিধান থেকে বিচ্যুতিরই ফল। তাই ‘সম্ভব নয়’ বলে বসে না থেকে সুদ বর্জনে সংকল্পবদ্ধ হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। মানুষ যখন সত্যিকারের সংকল্প করে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে চেষ্টা শুরু করে, তখন আল্লাহতায়ালা পথ খুলে দেন। এর অসংখ্য নজির আছে। সুদের এই ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যেও সমাজে এখনও এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা সুদ বর্জন করে চলছেন। সুতরাং যেকোনো মাধ্যম বা সূত্রের সুদ- অবশ্যই আমাদেরকে ত্যাগ করতে হবে।