রমজান বরণ

রামাদ্বান কারীম, ইসলাম

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 12:00:15

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে মহাসমারোহে বরণ করতেন। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, যখন রমজানের নতুন চাঁদ দেখতেন, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করতেন:

‘হে আল্লাহ, তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে চাঁদ, আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। হেদায়েত ও কল্যাণময় চাঁদ।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৪৫১)

‘চাঁদের ও আমার প্রতিপালক আল্লাহ’ উচ্চারণের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একত্ববাদ বা তাওহিদের দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। চাঁদকে বরণ করেছেন তাওহিদ তথা ঈমান ও হেদায়েতের আলোকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী রমজানের চাঁদকে বরণ করা ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের মধ্যেই উত্তম আদর্শ ও কল্যাণ নিহিত, যা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে, এমন প্রতিটি ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাৎ পেতে ইচ্ছুক এবং পরকালে মুক্তির আশা করে সে, যে তার আনুগত্য করেছে, তার সুন্নাতের অনুসরণ করেছে।’ (সুরা যুমার: আয়াত ২১)

ফলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ও কাজ তথা সুন্নতকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য। রমজানের চাঁদকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে অনুসরণে এই মর্মে [‘হে আল্লাহ, তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে চাঁদ, আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। হেদায়েত ও কল্যাণময় চাঁদ’] দোয়া পাঠ করে বরণ করার নেপথ্যে একটি ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। কেননা, তৎকালে আরবের মুশরিকরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদত ছেড়ে চাঁদের ইবাদত করতো। যে কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে চাঁদ আমি যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, তুমিও আল্লাহর সৃষ্টি। আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। তুমি আমার লাভ, ক্ষতি, জীবন, মরণ, রিজিক, দৌলত, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদি কোনো কিছুরই মালিক নও। যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কিছুর ইবাদত/উপাসনা করে, তারা মহা ভুল ও ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। বস্তুত, আমার ও তোমার প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন মাসের সুসংবাদ প্রদান করতেন।

অতএব রমজান মাস মানুষের কাছে তৌহিদের বাণী নিয়ে আসে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বরণ করেছেন তৌহিদের সুস্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে। ফলে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান দৃঢ়করণের প্রেরণা এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যেই যাবতীয় ইবাদত করার প্রত্যয় জাগ্রত হয় রমজান মাসে।

অন্য এক হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত হয়েছে:

‘যখন রমজান মাসের আগমন ঘটলো, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর শয়তানদের শিকল দিয়ে আবদ্ধ করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত্রি আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে তো প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭১৪৮)

অফুরন্ত নেয়ামতময় রমজানের আরেক অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা, মালিক ও পালনকর্তা রমজানের রোজার সাওয়াব তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদের নিজে দেবেন। বহুবিধভাবে পুরস্কৃত করার কথা রমজানের প্রতিক্ষণে রয়েছে। রয়েছে রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাত। রয়েছে ক্ষমা ও পাপমুক্তির সুবর্ণ সুযোগ।

রমজানের অপরিসীম গুরুত্বের কারণে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ ও অধিক আমল/ইবাদত করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য অতিশয় কল্যাণের বিষয়। সকলের উচিত আন্তরিকভাবে এবং তৌহিদের চেতনায় রমজানকে বরণ করা এবং মহান-মর্যাদাময় মাসটিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদতে মশগুল হয়ে রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাত হাসিল করা।

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মুসলিম উম্মাহর পূর্বসূরী মনীষীগণ রমজান মাসের আগমন হলে একজন অপরজনকে এ মাসের সুসংবাদ প্রদান করতেন, যেমনভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তৌহিদের ঘোষণার মাধ্যমে রমজানকে বরণ করতেন ও সাহাবাদের জানাতেন। মুসলিম মনীষীগণ রমজানে অন্যবিধ দুনিয়াবি কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন এবং পূর্ণ মনোযোগ ও উদ্যমে রমজানের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। ইমাম মালেক রাজিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, রমজান মাস আসলে তিনি কিতাব বন্ধ করে দিতেন। অজু করে পবিত্র কোরআন নিয়ে মসজিদে গমন করে বলতেন, এ তো কোরআনের মাস। এ মাসে কোরআন ছাড়া অন্য কোনো কথা চলতে পারে না।

দ্বীনের অনেক বুজুর্গ সম্পর্কেও বর্ণিত আছে যে, রমজান মাস এলে তারা সব সময় মসজিদে অবস্থান করতেন এবং অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত, চর্চা ও গবেষণা করতেন। আমল, তেলাওয়াত ও জিকির ছেড়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ ছেড়ে বাড়ি বা বাজারে যেতেন না। রমজান মাস এলে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাজিয়াল্লাহু আনহু ফতোয়া, মাসায়েল ইত্যাদি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তাসবিহ, তাহলিল, জিকির ও তেলাওয়াতে মশগুল হতেন। এতে রমজান মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবণ করা যায়। মূলত, আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত দেখা যায় রমজান মাসে, যা অনুসরণ করে রমজানকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করাই কল্যাণকর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর