রমজান মাসে রোজার কারণে দৈনন্দিন হাট-বাজার ও খাবার-দাবারের পেছনে সময় কম ব্যয় হয়। পরিবারের পুরুষ কর্তা এবং নারী কর্ত্রী নামাজ, রোজার পাশাপাশি পরিবার তথা সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার অধিক সুযোগ ও সময় লাভ করেন। ফলে পবিত্র মাহে রমজানে সন্তানদের আমল, আখলাক ও প্রশিক্ষণে ব্যস্ত হওয়ার অবকাশ পাওয়া যায়। বিশেষ করে, তাদেরকে নামাজ, রোজা শিক্ষা দেওয়া এবং পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্থ করার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া যেতে পারে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালনে পিতা-মাতা তথা অভিভাবকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা দরকার। কেননা, শিশু-কিশোরদের জন্য পরিবার হলো প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর পিতা-মাতা হলে জীবনের প্রথম শিক্ষক।
এ কথা খুবই সত্য যে, প্রতিটি মানুষই নিজ নিজ সন্তানকে জীবনে সফল দেখতে চায়। এজন্য মানুষ নানা রকম পদক্ষেপও গ্রহণ করে এবং পরিশ্রম করতে ও অর্থ ব্যয় করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু সন্তানের দুনিয়াবি সাফল্যের জন্য যে পরিমাণ শ্রম, অর্থ ও মনোযোগ ব্যয় করা হয়, দ্বীন ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য তা করা হয় না। বরং দ্বীন শিক্ষা ও আমলে অভ্যস্ত হলে সন্তান দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য যেমন লাভ করবে, তেমনি পিতা-মাতার জন্যও কল্যাণের কারণ হবে। এ কারণে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহের আলোকে সন্তান প্রতিপালনে তৎপর হওয়া দরকার এবং পবিত্র মাহে রমজানকে সন্তানদের দ্বীনি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রতিপালনের বিষয়ে সর্বাধিক মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা হযরত জাকারিয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেন:
‘এবং আমি তার স্ত্রীকে সুস্থ করে দিয়েছিলাম। এ লোকগুলো সব সময় সৎকাজে প্রতিযোগিতা করতো, তারা আমাকে আশা ও ভীতির সাথে ডাকতো, তারা সবাই ছিল আমার অনুগত বান্দা’ (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ৯০)।
এ আয়াতের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারে সৎকাজের মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি অনুগত বান্দা হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে এবং সেই সঙ্গে আশা ও ভয়ের মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালাকে ডাকার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য তথা সন্তানগণের ঈমান মজবুত হওয়ার এবং সৎকর্মশীল হওয়ার সুযোগ রয়েছে, যা তাদেরকে অপরাধ, অপকর্ম, নেশা, সন্ত্রাস থেকে বাঁচাবে এবং পরবর্তী জীবনে ঘুষ, দুর্নীতি ও অন্যান্য নাফরমানি থেকে রক্ষা করে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার অনুগত ও সফল বান্দায় পরিণত করবে।
সকলেই এই বিষয়ে অবগত যে, একজন শিশু ঘরে যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে, সেসব তার ভবিষ্যতের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই ঘরে সব সময় ঈমানের আলোচনা করা অপরিহার্য্য। নামাজের আমল করা দরকার। প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঘরকে জীবন্ত রাখা প্রয়োজন। তদুপরি হাদিস, মাসয়ালা ইত্যাদি জরুরি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের, বিশেষত শিশু-কিশোর সদস্যদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষিত করে তাদের জীবন গঠনের দায়িত্ব পিতা-মাতাকেই নিতে হবে। কারণ, একজন তরুণ সেই স্বভাব নিয়েই বেড়ে উঠে, যে স্বভাবে তার পিতা-মাতা তাকে অভ্যস্ত করেছে। ফলে সন্তানদের ভালো শিক্ষা ও অভ্যাসে অভ্যস্ত করানো পিতা-মাতার দায়িত্ব, যা দায়িত্ব মাহে রমজানে অধিকতরভাবে পালনের সুযোগ পাওয়া যায়।
এজন্য রমজান মাসের মোবারক পরিবেশে সন্তানদের নামাজ, রোজার সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র কোরআনের সঙ্গেও সম্পর্কিত করতে হবে। তাজবিদের সঙ্গে তেলাওয়াত শেখাতে হবে। নামাজের জন্য কতিপয় সুরা এবং প্রয়োজনীয় দোয়া মুখস্ত করাতে হবে। আমলের মতোই কথা, বার্তা, মেলামেশা তথা আখলাখের দিক থেকেও তাদেরকে স্বচ্ছ, সত্যবাদী ও সুন্দর করতে হবে। যাতে সন্তান চরিত্রবান রূপে গড়ে উঠতে পারে এবং মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, গিবত, শেকায়েত, বদগুমানি ইত্যাদির কবলে পতিত হয়ে জীবন বিনষ্ট না করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
‘মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে, কাজেই তোমাদের প্রত্যেকে যেন লক্ষ্য রাখে যে সে কাকে বন্ধু বানাবে’ (তিরমিজি শরিফ: ২৩৭৮)।
লক্ষ্য রাখতে হবে, সন্তান যেন স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বড় হয় এবং সে যেন তার স্বাভাবিক প্রতিভা বিকাশে সুযোগ পায়। চাপ, হট্টগোল, গালাগালি, মারপিটের মধ্যে সন্তান বড় হলে এসবের কুপ্রভাব তার মধ্যে পড়বে এবং সে সন্ত্রাস, মাদক ও অসামাজিক-অনৈতিকতার দিকে ধাবিত হয়ে যেতে পারে। ফলে এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। রমজান মাসে অধিক সময় তাদের সঙ্গে কাটাতে হবে এবং তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবে তাকে উন্নত চরিত্র ও উচ্চতর ব্যক্তিত্বে বিকশিত করার ব্যবস্থা শৈশবকাল থেকেই গ্রহণ করা পিতা-মাতার একান্ত কর্তব্য। মনে রাখা জরুরি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
‘মহান আল্লাহ উঁচু স্বভাব পছন্দ করেন, নিচু স্বভাব পছন্দ করেন না’ (মাজমায়ুজ জাওয়ায়েজ: ১৮৮)।
আমল ও আখলাকের মতোই সন্তানের পোষাক-পরিচ্ছদের প্রতিও পিতা-মাতার নজর রাখতে হবে। তার পোষাক যেন হয় শালিন, ভদ্রজনোচিত এবং অবশ্যই সুন্নাত মোতাবেক। আপত্তিকর পোষাক কিংবা অন্যের অনুকরণে পোষাক পরিধানের মধ্যে যে আদৌ কোনো বাহাদুরি নেই, সে শিক্ষা সন্তানকে শৈশবেই দিতে হবে। তাহলে সন্তান অন্ধ-অনুকরণের মাধ্যমে নিজের স্বকীয়তা ও আত্মসম্মান নস্যাৎ করে আচার, আচরণ, কথা, বার্তা, খাদ্য ও পোষাকের ক্ষেত্রে অপরের অনুগত দাসে পরিণত হবে না। বরং নিজের ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতির মজবুত অনুসারী হবে সন্তান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হবে’ (আবু দাউদ: ৪০৩১)।
ফলে এসব জরুরি বিষয় শৈশব থেকেই যখন একজন শিশু শিখবে, তখন সেগুলো তার অভ্যাসের অংশে পরিণত হবে এবং পরবর্তীতে সারা জীবনব্যাপী এসব অনুসরণ ও পালন করা তার পক্ষে সহজতর হবে। আমল, আখলাক, কথা-বার্তা, মেলামেশা, খাদ্য, পোষাক ইত্যাদি বিষয়ে পিতা-মাতা যদি সন্তানকে শৈশবে বাড়িতে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ না দেয়, তবে সে সন্তান দেখে-দেখে এমন কিছু শিখবে, যা তার আমল, আখলাক, কথা-বার্তা, মেলামেশা, খাদ্য, পোষাক ইত্যাদিকে বিপথগামী করবে এবং তাকে বিপদে ফেলে দেবে। আর সন্তানের বিপদের জিম্মাদার পিতা-মাতাও হবে এবং তার সুকর্মের মতো কুকর্মের প্রতিফলও পিতা-মাতাকে ভোগ করতে হবে।
অতএব, সারা বছরে তো বটেই, বিশেষ করে মাহে রমজানে পরিবার-পরিজন এবং সন্তানদের বিষয়ে অত্যাধিক মনোযোগী হওয়া অতীব জরুরি। আর এ কাজে প্রতিটি অভিভাবক তথা পিতা-মাতাকে অনুসরণ করতে হবে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা, যা আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা দোয়া হিসেবে শিক্ষা দিয়েছেন:
‘(নেক বান্দা তারাও), যারা বলে, হে আমাদের মালিক, তুমি আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো। তুমি আমাদের মুত্তাকী লোকদের ইমাম বানিয়ে দাও’ (সুরা ফোরকান: আয়াত ৭৪)।