পানাহার ও কাম রিপুকে দমন করে রোজা শরীরকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি দৃষ্টি সংযত করার মাধ্যমে চোখকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পরিপূর্ণ ও বিশুদ্ধ রোজার জন্য একজন মানুষের শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মন-মানসিকতা পূর্ণভাবে পরিশুদ্ধ ও আল্লাহর আদেশের অনুসারী হওয়া দরকার। সে কারণেই খাদ্য ও কামের চাহিদার মতোই চোখ, কান বা শ্রবণ শক্তিকেও রোজার আওতায় আনা প্রয়োজন। কেননা, আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:
‘কান, চোখ ও অন্তর, এ সব কয়টির ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’ (সুরা বনী-ইসরাঈল: আয়াত ৩৬)।
ফলে মানুষের অমূল্য শারীরিক নেয়ামত, যেমন চোখ, কান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে সঠিক, যথাযথ ও গঠনমূলকভাবে ব্যবহার করা অপরিহার্য। ভুল বা অন্যায় কাজে মানুষের শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অপব্যবহার শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্যেও মারাত্মক বিপদ ও কঠিন পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তদুপরি এজন্য চরম শাস্তি ও শক্ত জবাবদিহিতার সম্মুখীনও হতে হবে।
আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা আরো ইরশাদ করেছেন:
‘বস্তুত বহু সংখ্যক মানুষ ও জিন আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের কাছে যদিও অন্তর আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা চিন্তা করে না। তাদের কাছে চোখ থাকলেও তারা তা দিয়ে দেখে না। আবার তাদের কাছে কান আছে, কিন্তু তাদের কান দিয়ে শোনে না। এরা জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা তাদের চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট; এসব লোকেরাই মারাত্মক উদাসীন।’ (সুরা আরাফ: আয়াত ১৭৯)
শরীরিক কারণেই কান বা শ্রবণ শক্তি দেওয়া হয়েছে শোনার জন্য। ভালো কথা, ভালো শব্দ, ভালো ধ্বনি শোনার জন্য কান। কান এসব ইতিবাচক কাজে লাগানো হলে শরীর ও মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। নেককার ও বিচক্ষণ মানুষ কান বা শ্রবণ শক্তি দিয়ে এমনই ভালো কাজ করেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের নানা গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে, কানকে গঠনমূলক ও ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ও পরিমিত শব্দ না শুনলে যেমন শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি শব্দ দুষণ, হৈচৈ, উত্তেজক শব্দ মানুষের কানকে কষ্ট দেয়। তখন শ্রবণ শক্তি হ্রাস পায় এবং মনে কুপ্রভাবের মাধ্যমে হৃৎ ও মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন অপরাধের উস্কানিও কানের মাধ্যমে কুমন্ত্রণা রূপে মানুষের মনে সঞ্চারিত হয়, যা পাপের পথকে প্রশস্ত করে ও পবিত্র জীবনকে দুর্বিসহ নোংরা-পাপময় জীবনে পর্যবসিত করে।
এ কারণেই, কান বা শ্রবণ শক্তিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং পরিমিত ও ভালো কিছু শোনার কাজে ব্যবহার করা মানবজীবনের সুস্থতা, পবিত্রতা ও সফলতার জন্য অত্যাবশক। এতে কানের কার্যক্ষমতা যেমন ঠিক থাকবে, তেমনি শরীরও অহেতুক শব্দের কবলে নিপতিত হয়ে দূষিত-কলুষিত হবে না। সুস্থ, সবল ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের জন্য কান বা শ্রবণ শক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহারের বিষয়ে খেয়াল রাখা শুধু ধর্মীয় কারণেই নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যগত কুফল ছাড়াও ধর্মীয়-নৈতিক দিক থেকে কান বা শ্রবণেন্দ্রিয়কে ভুল বা পাপ কাজে লাগানোকে পশুর কাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশেষত, যে কান সৎ, সত্য, সঠিক কথা শুনতে আগ্রহী হয় না, সে কান ও কানের অধিকারী মানুষ, শ্রবণশক্তি থাকার পরেও সত্য ও ন্যায়ের চেয়ে অনেক দূরে অবস্থান করে। এমনকি, মানুষ হয়েও পশুর স্তরের বলে চিহ্নিত হয় সেসব লোকজন। যে কারণে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে:
‘হে নবী, আপনি কি মনে করেন, তাদের অধিকাংশ লোক আপনার কথা শোনে কিংবা এর মর্ম বোঝে; আসলে এরা পশুর মতো; বরং তারা আরো বেশি বিভ্রান্ত’ (সুরা ফোরকান: আয়াত ৪৪)।
অতএব যে কান বা শ্রবণ শক্তিকে সঠিক, সত্য, সৎ, হেদায়েতের কথা শোনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, রমজান মাসে রোজার আওতায় সে কানকে আরো সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হতে হবে। কোনো মিথ্যা, অশ্লীলতা, কুমন্ত্রণা, উস্কানি, গিবত, পরচর্চা ইত্যাদি ভুল ও বিভ্রান্তিকর বিষয় দিয়ে কান বা শ্রবণকে মোটেও কলুষিত করা যাবে না। শ্রবণকে কলুষিত ও অপবিত্র করার মাধ্যমে শরীর ও মনকে দুষিত হওয়ার বিপদ থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে কান বা শ্রবণকে হেফাজত করা জরুরি এবং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা অপরিহার্য।
অতএব, অন্যান্য সময়ের মতো পবিত্র রমজানে কানের রোজা হলো হারাম, মিথ্যা, ভুল, বিভ্রান্তিকর, অশ্লীল কথা বা শব্দ থেকে কানকে হেফাজত করা। উদ্দেশ্যমূলক, অপপ্রচার ও অপবাদমূলক, হিংসা, বিদ্বেষ, নেংরা, পাপময় কথা বা শব্দ বা প্রচারণা শোনা থেকে সযতেœ দূরে থাকা নিজের স্বাস্থ্যগত ও ধর্মীয় কারণেই জরুরি। মূল কথায়, দ্বীন, হক ও পবিত্র বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো অহেতুক ও পাপযুক্ত বিষয়ে কান বা শ্রবণ শক্তিকে কখনোই যেতে না দেওয়া। বরং কান ও শ্রবণ শক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিমদের হতে হবে সত্যের শ্রবণকারী বা সঠিক শ্রোতা। যে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে:
‘রাসুলের ওপর যা নাজিল হয়েছে তা যখন এরা শোনে, তখন সত্য চেনার কারণে আপনি এদের অনেকেরই চোখকে দেখতে পাবেন অশ্রুসজল’ (সুরা মায়েদা: আয়াত ৮৪)।
এ কারণেই ইসলামিক স্কলারগণ কান বা শ্রবণ শক্তিকে কেবলমাত্র সত্যবাদিতার কথা শোনায় নিয়োজিত করতে তাগিদ দিয়েছেন এবং নিরর্থক কথা শোনা থেকে সরে আসতে বলেছেন। কারণ, কান বা শ্রবণ ক্ষমতা হলো জ্ঞান ও ভালো কথা/উপদেশ/নির্দেশ/প্রজ্ঞার জানালা স্বরূপ। কানের মাধ্যমে সেইসব ইতিবাচক আলোচনা ও জিকির হৃদয়ে সংরক্ষিত করে নেওয়া উচিত। আর ‘আফজালুল জিকির’ বা সর্বোত্তম জিকির/কথা/আলোচনা হলো ‘জিকরুল্লাহ’ তথা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার জিকির বা আলোচনা, যা লিপিবদ্ধ করেছে ‘কালামুল্লাহ’ বা আল্লাহ তায়ালার কথা তথা আল কোরআনে।
আল্লাহ ও আল্লাহর কথা, উপদেশ, আদেশ, নিষেধ আলোচনার মাধ্যমে কানকে যেমন সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তেমনিভাবে কলব বা মনকে আলোকিত ও পরিশুদ্ধ করা যায়। আবার বাজে, অহেতুক, বেফুজুল, বেহুদা, বেশরম ও অসার কথাবার্তার মাধ্যমে কান বা শ্রবণ শক্তির অপব্যবহার করা হয় এবং মন ও হৃদয় এরূপ অপব্যবহারের দ্বারা কালিমালিপ্ত ও কলুষিত হয়।
ফলে তাকওয়া ও পরহেজগারি লাভের উদ্দেশ্যে রোজা রাখবো আর কানকে ভুল ব্যবহার করার মাধ্যমে হৃদয়-মনকে কলুষিত, অপবিত্র ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করবো, তা কোনো কাজের কাজ হতে পারে না। বরং এতে রোজার যে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেটাই নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। অতএব পরিপূর্ণভাবে রোজার হক আদায় করার জন্য শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষত কান বা শ্রবণ শক্তিকেও সংযমের মাধ্যমে রোজায় শরিক করা অত্যাবশ্যক।