কথা বা জবানের রোজা 

, ইসলাম

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:24:48

জবান বা কথার কারণে মানুষ সাওয়াব যেমন কামাই করতে পারে, তেমনি গোনাহ কামাই করতে পারে। এ কারণে কথা বা জবানের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রোজা পালনকালে কথা বা জবানের ব্যাপারে অধিকতর সর্তকতা কাম্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লেখার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (সুরা কাফ: আয়াত ১৮)।

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ জিহ্বা এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ গুপ্তাঙ্গ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো’ (বোখারি শরিফ: ৬৪৭৪)।

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণ সর্বসম্মতভাবে এ কথা বলেছেন যে, কথা বা শব্দের পদস্খলনই বিপদ বা ধ্বংসের কারণ হয়। জ্ঞানী ও বিচক্ষণ মানুষ সব সময় কম কথা বলেন এবং কথা মেপে মেপে বলেন। কারণ, অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি কথা বললে ভুল, মিথ্যা বা বিপজ্জনক কথা বের হওয়ার আশঙ্কা অধিক। ফলে ঈমানদার, প্রজ্ঞাবান ও সচেতন মানুষ কম কথা বলেন। তারা সর্বদা আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার জিকিরে জিহ্বাকে ব্যস্ত রাখেন। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার ভয়ে তারা কথা বলার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। মিথ্যা, মন্দ, অশ্লীল ও অহেতুক কথা থেকে নিজেকে হেফাজত রাখার জন্য সব সময় অস্থির থাকেন। কারণ, তারা জানেন যে, প্রতিটি কথাই লিপিবদ্ধ হয় এবং সে অনুযায়ী ভালো কথার পুরস্কার ও খারাপ কথার শাস্তি দেওয়া হয়। এজন্য তারা আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার জিকির, ভালো কথার বাইরে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। বরং অধিকাংশ সময়ে নিশ্চুপ থেকে দ্বীন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করেন।

পক্ষান্তরে, আরেকদল মানুষ আছে, যারা নিজের কথা বা জিহ্বার লাগাম ছেড়ে দেয়। সব সময় অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় বা অশ্লীল কথা বলতে পরোয়া করে না। সুযোগ পেলেই গিবত-পরচর্চা, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র করতে পিছপা হয় না। জবানকে তারা চক্রান্ত ও অপরের ক্ষতির কাজেই নিয়োজিত করতে সাময়িক তৃপ্তি পায়, এমন লোকের সংখ্যা সমাজে অনেক। অথচ হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট ভাষায় হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে যে:

‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জবান ও হাত দ্বারা অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’ (বোখারি শরিফ: ৬৪৮৪)।

কথা বা জবানের ব্যাপারটি কত গুরুত্বপূর্ণ, তা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকেও জানা যায়। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘হে নবী, আমার বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন কথা বলার সময় এমন সব কথা বলে, যা উত্তম। কেননা, শয়তান তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রতি উৎসাহিত করে’ (সুরা বনী ইসরাঈল: আয়াত ১২)।

আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা আরো ইরশাদ করেছেন:

‘একজন আরেক জনের গিবত করো না, তোমাদের  কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবেÑআর অবশ্যই তোমরা তা অত্যন্ত ঘৃণা কর’ (সুরা হুজরাত: আয়াত ১২)।

অতএব কথা বলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভুল বা বিপজ্জনক কথা, যেমন মিথ্যা, গিবত, কুটনামি ইত্যাদি কথার মাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা অশেষ বিশৃঙ্খলা ও শাস্তির কারণ। কথার দ্বারা কমপক্ষে দশটি বিপদের বিষয়ে ইসলামী স্কলারগণ সতর্ক করেছেন। সেগুলো হলো: মিথ্যা, গিবত, চোগলখোরি, বেহুদা বকবকানি, গালি-গালাজ, অশ্লীলতা, অভিসম্পাদ, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, উস্কানি, হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার ইত্যাদি। যারা অসতর্ক হয়ে, নিজের মনের খেয়ালে ও বেপরোয়া-লাগামহীনভাবে কথা বলে, তাদের দ্বারা এসব বিপদ ঘটার আশঙ্কা সর্বাধিক।

কখনো এমন হয় যে, বলতে বলতে বেশি কথা বলাটাই কিছু মানুষের অভ্যাস হয়ে যায়। সাধারণ কাজের মতোও সে তখন মিথ্যা, গিবত ইত্যাদি বলতে থাকে। এগুলো যে চরম অপরাধ ও গোনাহের কাজ, তা অনুধাবণ করার মতো ক্ষমতা বা মানসিক পরিস্থিতিও তার থাকে না। বেশি কথা বলার কু-অভ্যাসের দাস হয়ে সে প্রতিদিনই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আজেবাজে ও অহেতুক কথা বলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ এবং গোনাহের ভাগীদার হতে থাকে।

রমজান মাসে কৃচ্ছ্বতার সময়ও কারো কারো মধ্যে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব দেখা যায়। অকাতরে মিথ্যা, গিবত, চোগলখোরি, বেহুদা বকবকানি, গালি-গালাজ, অশ্লীলতা, অভিসম্পাদ, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, উস্কানি, হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার, কুৎসা, পরচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্য মানুষের এবং নিজের বিপদ সৃষ্টি এবং আশেপাশের পরিবেশ বিনষ্ট করতে অনেকেই তৎপর হয়। সারা বছরের বদঅভ্যাসের দাস হয়ে রমজানের পবিত্র পরিবেশকেও বিনষ্ট করে কেউ কেউ তৎপর হয়। অথচ তাদের রোজা কতটুকু কাজে আসবে, সে ব্যাপারে তারা মোটেও ভাবনা-চিন্তা করেনা। বরং এসব অপকর্মের মাধ্যমে রোজা নষ্টের পাশাপাশি অন্য রোজাদারকে কষ্ট দিয়ে অধিক গোনাহের ভাগীদার হয় সেইসব দুর্ভাগা লোকগুলো। ফলে রোজার সময় শারীরিক সংযমের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গ তথা জবানের নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি এবং জবান বা কথার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা বিষেশভাবে অপরিহার্য্য। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর