সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। পরিবেশে জীবের বাসোপযোগী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে- পানি ও মাটি। মূলত মাটি থেকেই অনেক কিছু উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ –সুরা ইয়াসিন : ৩৩
পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাগিদ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ –সুরা বাকারা : ১৯৫
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ –সুরা আর রুম : ৪১
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলাম বৃক্ষরোপণের তাগিদ দিয়েছে। এমনকি বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণের পর যতদিন পর্যন্ত মানুষ ও জীবজন্তু ওই বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত ফল ভোগ করবে, ছায়া পাবে, ততদিন পর্যন্ত রোপণকারীর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব লেখা হতে থাকবে। -সহিহ বোখারি : ২১৫২
গাছপালা ও বনভূমি ছাড়া মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারণ অসম্ভব। যথেষ্ট পরিমাণে গাছপালা ও বনভূমি না থাকলে পরিবেশ হবে উষ্ণ, পৃথিবী হবে মরুভূমি-ধূলিময়। এতে পরিবেশ হবে বিপন্ন। মানুষ পতিত হবে বহুল বিপর্যয়ে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের মোট বনভূমির আয়তন হচ্ছে ১৭.৪ ভাগ। এ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বনভূমি খুবই কম। দিন দিন কমে যাচ্ছে বনভূমির আয়তন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছ কেটে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে। মানুষের কাঠ ও জ্বালানি কাঠের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বনভূমি। নগরায়ন ও শহরায়নের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেও ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। বিলুপ্ত হচ্ছে জীবজন্তু ও বন্যপ্রাণী। এতে হুমকির মুখে পড়ছে দেশ ও দেশের মানুষ। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবী থেকেও বনভূমি দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। কোরআনে কারিমে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও।’ –সুরা আল বাকারা : ২২২
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা, জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’ –সুরা কাফ : ৭-৮
তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ করে বাংলাদেশের বনভূমিকে মোট আয়তনের ২৫ ভাগে নিয়ে যাওয়ার। সহিহ বোখারির হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা ফসল উৎপন্ন করে আর তা থেকে মানুষ ও পশুপাখি ভক্ষণ করে, তাহলে উৎপন্নকারীর আমলনামায় তা সদকার সওয়াব হিসেবে গণ্য হবে।’
পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার জন্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও ফসলাদি উৎপন্ন করার জন্য ইসলাম পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণের প্রতি বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা জানি, গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। এই গাছ ইচ্ছা হলেই কাটা যাবে না। কারণ ‘গাছের প্রাণ আছে’- এটা হাদিসের বাণী।
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে জানা যায়, এক লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙে, তখন নবী করিম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, তুমি যেমন শরীরে আঘাত পেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।
পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবী (সা.)-এর হাদিস থেকে পাই। তিনি বলেছেন, যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও। সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তাঘাট পরিস্কার থাকা অপরিহার্য।
পৃথিবী নামক ছোট এই গ্রহে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সব উপাদান দিয়ে আল্লাহতায়ালা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের নানাবিধ অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বস্তুত প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণে সুষ্ঠু নিয়ম মেনে চলা, মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া, বন-বনানী থেকে বৃক্ষ উজাড় না করা, গগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরির জন্য পাহাড় না কাটা, পশুপাখি নির্বিচারে শিকার না করা, কলকারখানার বর্জ্য নিস্কাশনে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনসাধারণকে পরিবেশ সম্পর্কে আরও অধিক সচেতন করে তোলা। তাহলেই কেবল সম্ভব সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তা।
মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে মানুষকে টিকে থাকতে হলে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তা নিজেদেরই দিতে হবে।