সৌদি আরবকে সরিয়ে ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বের জন্য লড়াই করছে তুরস্ক। এ লক্ষে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান গত অক্টোবরে (২০২১) একযোগে আফ্রিকার তিনটি দেশ সফর করেন। দেশগুলো হলো- কোভারস এঙ্গোলা, নাইজেরিয়া ও টোগো। তার এই সফরকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন।
আফ্রিকার বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে এরদোগানের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। তিনি প্রায়ই ওইসব দেশের নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপ করেন। করোনা ভাইরাস মহামারির সময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সহায়তা করেছে তুরস্ক। এভাবে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক তৎপরতা ক্রমেই বাড়ছে।
এরদোগান চার দিনের সফর শুরু হয় এঙ্গোলা দিয়ে। সফরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান এ দেশটিতে আরও ব্যাপক বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে তুরস্ক ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছে।
এরপর এরদোগান নাইজেরিয়া যান, ২০১৬ সালের মার্চে সর্বশেষ তিনি মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশ সফর করেছিলেন। পরে এরদোগানের আমন্ত্রণে ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বুহারিও তুরস্ক সফর করেন। এরদোগান তখন নাইজেরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তুরস্ক প্রস্তুত বলে জানান।
এবার এরদোগানের আফ্রিকা সফর শেষ হয় টোগোতে। গত আগস্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট ফাউরি এসোজিমনা গাসিংবের সঙ্গে এরদোগান টেলিফোনে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তখন এরদোগান দেশটির সামরিক শক্তি উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সফরের আলোচ্যসূচিতে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলো গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড় প্রতিনিধিদল নিয়ে এরদোগান সফর করেন। আফ্রিকার দেশগুলোতে এ ধরনের সফর তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির একটি নিয়মিত অংশে পরিণত হয়েছে। আগে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আফ্রিকা তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিতে ‘অনাবিষ্কৃত’ ছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকের আগ পর্যন্ত তুরস্ক আফ্রিকা মহাদেশের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিল না। ১৯৯৮ সালে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফ্রিকার ব্যাপারে একটি নীতি প্রণয়ন করে। ওই নীতিতে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ওই মহাদেশে তুরস্কের পদচিহ্ন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি ‘অ্যাকশন প্লান’ গ্রহণ করা হয়। ওই মহাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটি মাইলফলক।
এ ছাড়া ২০০৮ সালে আফ্রিকান ইউনিয়ন তুরস্ককে তাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ঘোষণা করলে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আরও সম্পর্কোন্নয়নের একটি দৃঢ় ভিত্তি পেয়ে যায় আঙ্কারা।
অন্যদিকে আফ্রিকা ‘রাইজিং ইকোনমিক স্টারে’ পরিণত হয়েছে। তাই কয়েকটি আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে আঙ্কারা বহু সময় ও শক্তি ব্যয় করছে। এ ক্ষেত্রে আঙ্কারার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ প্রমাণ প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অতি সাম্প্রতিক সফর।
সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক। তারা সামরিক জোট ন্যাটোরও সদস্য। কামাল আতাতুর্কের আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের নীতির কারণে তুরস্ক সম্পর্কে ইসলামি বিশ্বে একধরনের দ্বিধা ছিলো, তবে এরদোগানের আমলে তুরস্কের এ ভাবমূর্তির বদল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বকাল মিলিয়ে এরদোগান অনেক দিন ধরেই তুরস্কের ক্ষমতায়। তিনি ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত। তুরস্কে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন তিনি। এরদোগানের জোর প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে মুসলিম বিশ্বে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে অনেকে তুরস্কের নতুন সুলতান সুলেমান বলে অভিহিত করেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এরদোগান শুধু নিজ দেশের সুলতান হতে চান না; তার লক্ষ্য আরও বড় কিছু- তিনি মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চান। এই লক্ষ্য থেকেই ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন ফোরাম ও উপলক্ষে এরদোগান নিজের যোগ্যতা তুলে ধরছেন। যেমন ২০১৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে এরদোগান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সুন্নি বা শিয়া নই, আমার ধর্ম ইসলাম।’
রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে এরদোগানকেই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়। ফলে অনেকের অভিমত, এরদোগান তুরস্কের হারানো শৌর্যবীর্য ফিরিয়ে আনতে চান। একইসঙ্গে তুরস্ককে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তিনি হতে চান মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা।
রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যেই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি মুসলিম বিশ্বকে একটা বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। এই সংকটের শুরু থেকেই যথারীতি সোচ্চার এরদোগান, যেখানে সৌদি আরব চুপ। ফলে এরদোগান তিনি হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিন তথা বিশ্বের মুসলমানদের কণ্ঠস্বর। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ কাতার অবরোধ করলে কাতারের পাশে দাঁড়ায় আঙ্কারা। তার এই ভূমিকা ও তৎপরতা মুসলিম বিশ্বের নজর কেড়েছে, ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এরই মাঝে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চার দিনের আফ্রিকা সফর বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে ৩০টিতে সরকারি সফর করেছেন। এই সফরগুলো আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের উন্নতির লক্ষণ। তুরস্ক কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে, পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তি করেছে। এর আওতায় সেখানে কাজ করবে তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা (টিআইকেএ), পতাকাবাহী তুর্কি এয়ারলাইন্স, ইউনুস এমরে ইনস্টিটিউট এবং তুর্কি মারিফ ফাউন্ডেশন।
তুরস্ক ১৯২৫ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে প্রথম দূতাবাস চালু করে। এটি ছিল আফ্রিকা মহাদেশে তাদের প্রথম দূতাবাস। সাব-সাহারান আফ্রিকায় প্রথম দূতাবাস ইথিওপিয়ায় ছিল এবং সেটি ১৯২৬ সালে খোলা হয়েছিল। তুরস্ক প্রতি বছর মহাদেশটির সঙ্গে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেই চলছে। ২০০৯ সাল থেকে তারা আফ্রিকাজুড়ে মোট ৩১টি দূতাবাস খুলেছে। এর আগে, তুরস্কের মাত্র ১২টি আফ্রিকান দেশে দূতাবাস ছিল- যা পরবর্তী বছরগুলোতে ৪৩ এ উন্নীত হয়। মহাদেশে দূতাবাসের সংখ্যা ৫০-এ উন্নীত করার লক্ষ্যে তুরস্ক পশ্চিম আফ্রিকার গিনি-বাসাউয়ের রাজধানী বাসাউতে ৪৪তম দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা করছে।
তুর্কি এয়ারলাইন্স আফ্রিকার ৬০টিরও বেশি গন্তব্যে চলে। আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও মহাদেশের অনেক দেশে তুরস্কের সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে। তারা ১৯৫৬ সালে আফ্রিকাতে প্রথম ফ্লাইট করেছিল এবং এখন ৪০টি দেশে উড়ে যাচ্ছে। মহাদেশের মোট গন্তব্য এখন ৬১টি, সর্বশেষ সংযোজন অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডার।
শিক্ষাক্ষেত্রে তুর্কি মারিফ ফাউন্ডেশন আফ্রিকাজুড়ে সক্রিয়। যেখানে কয়েক ডজন স্কুল রয়েছে। ফাউন্ডেশনটি ১৭ হাজার ৫৬৫ আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের ২৬টি দেশের ১৭৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তুরস্ক উচ্চশিক্ষায় আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাচ্ছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্সি ফর টার্কস অ্যাব্রাড অ্যান্ড রিলেটেড কমিউনিটিস (ওয়াইটিবি) ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের মোট ৫ হাজার ২৫৯ জন শিক্ষার্থীকে সহায়তা দিয়েছে। বর্তমানে ৪ হাজার ৪০৩ জন আফ্রিকান শিক্ষার্থী তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে অধ্যয়নরত, যার মধ্যে ৫১টি আফ্রিকান দেশ থেকে ৮ হাজার ৭৮৬ জন।
টিকা (টিআইকেএ) এবং ইউনুস এমরে ইনস্টিটিউট উভয়েই উন্নয়ন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের প্রকল্পের মাধ্যমে আফ্রিকানদের সেবার জন্য কাজ করে। টিকা তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত সাহায্য সংস্থা, আফ্রিকাতে তাদের ২২টি প্রতিনিধি অফিস রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করে; ইউনুস এমরে ইনস্টিটিউট ১০টি দেশে তার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে কাজ করে। ইনস্টিটিউটের উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া, মরক্কো এবং তিউনিশিয়ায় অফিস রয়েছে; পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, সুদান এবং রুয়ান্ডা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল, মৌরিতানিয়া এবং গাম্বিয়া। নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজায় এর সদর দফতর, এটি তুর্কি ভাষার প্রচারের জন্য কাজ করে। এটি সংস্কৃতি এবং শিল্পেও সক্রিয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আফ্রিকানদের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
তুরস্ক এবং আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার আরেকটি প্রধান ক্ষেত্র হলো- নিরাপত্তা। আঙ্কারা ১৯টি দেশে সামরিক চুক্তি করেছে। বহুদিন ধরেই তুর্কি সেনারা জাতিসংঘের মাল্টি ডাইমেনশনাল ইন্টিগ্রেটেড স্ট্যাবিলাইজেশন মিশনের (এমআইএনইউএসএমএ) সঙ্গে পশ্চিম আফ্রিকান দেশ এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের জন্য কাজ করছে। ২০১৭ সালে তুরস্ক সোমালিয়ার সঙ্গে একটি যৌথ টাস্কফোর্স কমান্ড প্রতিষ্ঠা করে, যা আঙ্কারার বৃহত্তম বিদেশী সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
এভাবেই নানাভাবে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী হয়েছে তুরস্ক। অথচ এক সময় আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে সৌদি আরবের ছিল প্রভূত প্রভাব। কিন্তু নানা কারণে সৌদি আরব সে জায়গা ধরে রাখতে পারেনি। সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে তুরস্ক। এখন সময়ই বলবে তুরস্কের কূটনৈতিক তৎপরতা কতটা সফল?