কোরআনে কারিমের অনেক জায়গায়ই একের সঙ্গে অন্যের তুলনা উপস্থিত করা হয়েছে। এ তুলনা উপস্থিত করার ব্যাপারে একটি অবিশ্বাস্য মিল লক্ষ্য করা গেছে এবং তা হচ্ছে, সে দু’টি নাম অথবা বস্তুকে আল্লাহতায়ালা তার কিতাবে সমান সংখ্যায় উল্লেখ করেছেন। এ তুলনার ক্ষেত্রে আরেকটি অলৌকিক বিষয় হলো, যেখানে তুলনাটি অসম সেখানে সংখ্যা দু’টিকেও অসম রাখা হয়েছে। যেমন, কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘সুদ’ এবং ‘বাণিজ্য’ এক নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ শব্দ দু’টির একটি কোরআনে এসেছে ছয় বার এবং অন্যটি এসেছে সাত বার।
বলা হয়েছে, জান্নাতের অধিবাসী আর জাহান্নামের অধিবাসী সমান নয়।’ জান্নাতের সংখ্যা হচ্ছে- আট আর জাহান্নামের সংখ্যা সাত। কিন্তু ‘জান্নাত’ ও ’জাহান্নাম’ শব্দ দু’টো কিন্ত একই রকম এসেছে, মোট ৭৭ বার করে।
ঠিক তেমনিভাবে ‘কাজ’ এর পরিণাম হচ্ছে- ‘বিনিময়’, তাই দু’টো শব্দ এসেছে ১০৭ বার করে। কাউকে ভালোবাসলে তার আনুগত্য করা যায়, তাই এ দু’টো শব্দও কোরআনে সমান সংখ্যক অর্থাৎ ৮৩ বার করে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘নারী ও পুরুষ’- যে আল্লাহর কাছে সমান তা কোরআনে এই শব্দ দু’টোর সমান সংখ্যা থেকেই আমরা বুঝতে পারি। কোরআনে এ দু’টো শব্দ এসেছে ২৪ বার করে।
সুরা ‘আরাফ’-এর এক আয়াতে আছে ‘যারা আমার স্পষ্ট আয়াতসমূহ অস্বীকার করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে- কুকুরের মতো।’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমরা দেখি, ‘যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতকে অস্বীকার করে’ এ বাক্যটি কোরআনে সর্বমোট পাঁচবার এসেছে। যেহেতু তাদের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে কুকুরের সঙ্গে, তাই সমগ্র কোরআনে ‘আল কালব’ তথা কুকুর শব্দটাও এসেছে পাঁচবার।
‘সাবয়া সামাওয়াত’ কথটির অর্থ হলো- ‘সাত আসমান।’ আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোরআনে এ ‘সাত আসমান’ কথাটা ঠিক সাত বারই এসেছে। ‘খালকুস সামাওয়াত’ আসমানসমূহের সৃষ্টির কথাটাও সাত বার এসেছে, সম্ভবত আসমান সাতটি তাই। ‘সাবয়াতু আইয়াম’ মানে ৭ দিন। এ কথাটাও কোরআনে সাতবার এসেছে। ‘সালাওয়াত’ শব্দটি সালাত এর বহুবচন। কোরআনে সালাওয়াত শব্দটি ৫ বার এসেছে, সম্ভবত ৫ বার নামাজ ফরজ হওয়ার কারণে এটা এভাবে বলা হয়েছে।
‘দুনিয়া ও আখেরাত’ এ দু’টি কথাও কোরআনে সমান সংখ্যায় এসেছে সর্বমোট ১১৫ বার করে। ‘ঈমান ও কুফর’ শব্দ দু’টোও সমপরিমাণ বলা হয়েছে, অর্থাৎ ২৫ বার করে। ‘উপকার ও ক্ষতি’ সমভাবে এসেছে ৫০ বার করে। ঠিক একইভাবে ‘শান্তি’ ও ‘অশান্তি’ শব্দটি এসেছে ১৩ বার করে। ‘গরম ও ঠান্ডা’ যেহেতু দু’টো বিপরীতমুখী ঋতু তাই এ শব্দ দু’টো কোরআনে ৫ বার করে এসেছে। ‘সূর্য’ আলো দেয় বলে দু’টো শব্দই কোরআনে সমান সংখ্যায় এসেছে, ৩৩ বার করে।
কাজ করলে কাজের পুরস্কার দেওয়া হবে বলেই সম্ভবত ‘কাজ করা’ ও ‘পুরস্কার’ শব্দটি এসেছে ১০৮ বার করে। আরবি ভাষায় ‘কুল’ মানে ‘বলো’ তার জবাবে বলা হয় ‘কালু’ মানে ‘তারা বললো।’ সমগ্র কোরআনে এ দু’টো শব্দও সমান সংখ্যক, অর্থাৎ ৩৩২ বার করে এসেছে। ‘বক্তৃতা’ বা ‘ভাষণ’ ‘মুখ’ থেকে আসে তাই তাই উভয় শব্দ এসেছে ২৫ বার করে।
আর রাসুল শব্দটি এসেছে ৫০ বার, আর যাদের কাছে রাসুলদের পাঠানো হয়েছে সে মানুষের কথা এসেছে ৫০ বার। পুণরাবৃত্তিসহ কোরআনে সব নবীদের নাম এসেছে ৫১৩ বার। বিস্ময়ের ব্যাপার রাসুল শব্দের মূল ধাতু অর্থাৎ ‘রেসালাহ’ শব্দটিও কোরআনে ৫১৩ বার।
জিহবা দিয়ে মানুষ বক্তৃতা দেয় বলে, ‘জিহবা’ ও ‘বক্তৃতা’ শব্দটি সমান সংখ্যক ৫০ বার করে এসেছে। মানুষ যখন জনগণের নিকট থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে একটু জোরে কথা বলতে হয়, তাই কোরআনে ‘জোরে কথা বলা’ ও ‘জনগণের সামনে’ এ উভয়টাই এসেছে ১৬ বার করে।
আলোর সঙ্গে সম্পর্ক মানুষের মানুষের মনের। মনে আলো জ্বললেই তা দিয়ে দুনিয়ায় আলো ছড়ানো যায়। এ কারণেই সম্ভবত ‘মন’ ও ‘আলো’ শব্দ দু’টি কোরআনে একই সংখ্যায় এসেছে, মোট ৪৯ বার করে।
আল্লাহতায়ালা ‘বিপদে’ ‘শোকর’ আদায় করতে বলেছেন, তাই এই উভয় শব্দ এসেছে ৭৫ বার করে। আল্লাহর ‘রহমত’ হলে ‘হেদায়েত’ আসে তাই এই শব্দ দু’টো ও সমান সংখ্যায় এসেছে ৭৯ বার করে। কোরআনে ‘খেয়ানত’ শব্দটি এসেছে ১৬ বার, আর যে খেয়ানত করে সে একজন ‘খবিস’ কিংবা খারাপ লোক, তাই এ শব্দটিও এসেছে ১৬ বার। ‘মালাকুন’ কিংবা ‘মালায়েকা’ মানে ফেরেশতা কিংবা ফেরেশতারা। কোরআনে এটি এসেছে ৮৮ বার, একইভাবে ফেরেশতার চির শত্রু ‘শয়তান’ কিংবা ‘শায়াতীন’ এটিও এসেছে ৮৮ বার।
আবার ‘আল খাবিস’ মানে অপবিত্র, ‘আত তাইয়্যেব’ মানে পবিত্র, সমগ্র কোরআনে এ দু’টি শব্দমোট ৭ বার করে অর্থাৎ একই সংখ্যায় নাজিল হয়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে দুনিয়ায় ভালোর চাইতে মন্দ তো বেশি, এখানে দু’টো শব্দ সমান রাখা হলো কিভাবে? এ কথার জবাবের জন্য কোরআনের ‘সুরা আনফালের ৩৭ নম্বর আয়াতটির দিকে লক্ষ করা যাক। এখানে আল্লাহ বলেছেন, ‘অপবিত্রকে পবিত্র থেকে আলাদা করার জন্য তিনি অপবিত্রকে একটার ওপর আরেকটা রেখে তাকে পুঞ্জীভূত করেন এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে ফেলে দেনে।’ এতে বুঝা যায়, যদিও পাপ পুণ্য সমান সংখ্যায় এসেছে, কিন্তু পুঞ্জীভূত করা দিয়ে তার পরিমাণ যে বেশি তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
‘ইয়াওমুন’ মানে ‘দিন’ সমগ্র কোরআনে এ শব্দটি ৩৬৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। বছরে যে ৩৬৫ দিন এটা কে না জানে। ইয়াওমুন শব্দের বহুবচন ‘আইয়াম’ মানে দিনসমূহ, এ শব্দটি এসেছে ৩০ বার। আরবি ভাষায় চাঁদ হচ্ছে- মাসের সূত্র সুচক, গড়ে বছরের প্রতি মাসে ৩০ দিন, আর এটাই হচ্ছে চন্দ্র বছরের নিয়ম। হতবাক হতে হয় যখন দেখি, চাঁদের আরবি প্রতিশব্দ ‘কামার’ শব্দটি কোরআনে মোট ৩০ বারই এসেছে। ‘শাহরুন’ মানে মাস, কোরআন মাজিদে এ শব্দটি এসেছে মোট ১২ বার। ‘সানাতুন’ মানে বছর, কোরআনে এ শব্দটি এসেছে ১৯ বার। কারণ হিসেবে আমরা সম্প্রতি আবিস্কৃত গ্রীক পন্ডিত মেতনের মেতনীয় বৃত্তের কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনিই প্রথমে এ তত্ব আবিস্কার করেন যে, প্রতি ১৯ বছর পর সূর্য ও পৃথিবী একই বৃত্তে অবস্থান করে।
কোরআনের আরেকটি বিস্ময়কর শব্দ হচ্ছে- ‘রাত’ ও ‘রাতগুলো’, এ উভয় সংখ্যা কোরআনে এসেছে সর্বমোট ৯২ বার, ‘আল লাইল’ অর্থাৎ রাত নামের সুরাটির ক্রমিক সংখ্যাও হচ্ছে- ৯২।
কোরআনে চাঁদ শব্দটি সর্বমোট ২৭ স্থানে এসেছে। আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষীণ করতে সময় লাগে ঠিক ২৭.০৩ দিন অর্থাৎ ২৭ দিন ৭ ঘন্টা ৪৩ মিনিট। কোরআনে ‘ফুজ্জার’ পাপী শব্দটি যতবার এসেছে, ‘আবরার’ পুণ্যবান শব্দটি তার দ্বিগুণ এসেছে। অর্থাৎ ‘ফুজ্জার’ ৩ বার আর ‘আবরার’ ৬ বার। এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহ সবসময় শাস্তির তুলনায় পুরস্কারের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন।
কোরআনের সুরা সাবার ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘এ ধরণের লোকদের জন্য (কেয়ামতে) দ্বিগুণ পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। এটা হচ্ছে বিনিময় সে কাজের যা তারা দুনিয়ায় করে এসেছে।’ এ কারণেই দেখা যায়, গোটা কোরআনে ‘পাপী’ ও ‘পুণ্যবান’ শব্দের মতো, ‘আজাব’ শব্দটি যতবার এসেছে ‘সওয়াব’ শব্দটি তার দ্বিগুণ এসেছে।
কোরআনে একাধিক জায়গায় আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে তিনি তার বিনিময় বাড়িয়ে দেবেন। সম্ভবত এ কারণেই কোরআনে ‘গরীবী’ শব্দটি এসেছে ১৩ বার, এর বিপরীতে ‘প্রাচুর্য’ শব্দটি এসেছে ২৬ বার।
কোরআন কারিমের বিভিন্ন জায়গায় এভাবে গাণিতিক সংখ্যার অদ্ভতু মিল দেখে যেকোনো কোরআন পাঠকই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবতে থাকে, এটা নিঃসন্দেহে কোনো মানুষের কথা নয়।
কোনো একটা কাজ করলে তার যে অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়াবে তার উভয়টিকে আশ্চর্যজনকভাবে সমান সংখ্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। ‘গাছের চারা’ উৎপাদন করলে ‘গাছ’ হয়। তাই এ দু’টো শব্দই এসেছে ২৬ বার করে। কোনো মানুষ ‘হেদায়েত’ পেলে তার প্রতি ‘রহমত’ বর্ষিত হয়, তাই এ দু’টো শব্দ কোরআনে এসেছে ৭৯ বার করে। হেদায়েতের অপরিহার্য পরিণাম হচ্ছে- ‘মউত’ এ শব্দ দু’টোও এসেছে ১৬ বার বরে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘জাকাত’ দিলে ‘বরকত’ আসে, তাই কোরআনে কারিমে ‘জাকাত’ শব্দ এসেছে ৩২ বার ‘বরকত’ শব্দও এসেছে ৩২ বার। ‘আবদ’ মানে গোলামি করা, আর ‘আবিদ’ মানে গোলাম। গোলামের কাজ গোলামি করা, তাই কোরআনে এই উভয় শব্দই এসেছে ১৫২ বার করে। মানুষ ‘সৃষ্টি’ কথাটা এসেছে ১৬ বার, আর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে- ‘ইবাদত’ তাই এ শব্দটিও এসেছে ১৬ বার।
‘নেশা’ করলে মাতাল হয়, তাই এ দু’টো শব্দ এসেছে ৬ বার করে। প্রতিটি ‘দুঃখ কষ্টে’ আল্লাহ মানুষের ধৈর্য ধরতে বলেছেন- কোরআনে এই উভয় শব্দেই এসেছে ১০২ বার করে। ‘উপকার’ ও ‘ক্ষতি’ এসেছে ৫০ বার করে। আল্লাহ আমাদের শয়তান থেকে আশ্রয় চাইতে বলেছেন, সম্ভবত এই কারণে কোরআনে যতবার ‘শয়তানের’ নাম এসেছে ঠিক ততবারই ‘আশ্রয় চাওয়ার’ কথাও এসেছে, অর্থাৎ উভয়টাই ১১ বার করে এসেছে।
কোরআনে ‘ইনসান’ শব্দটি এসেছে ৬৫ বার। এবার ইনসান বানানোর উপকরণগুলোকে কোরআনের বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগ করে মিলিয়ে দেখা যাক। প্রথম উপাদান ‘তোরাব’ (মাটি) শব্দটি এসেছে ১৭ বার, দ্বিতীয় উপাদান ‘নুতফা’ (জীবনকণা) শব্দ এসেছে ১২ বার, তৃতীয় উপাদান ‘আলাক’ (রক্তপিন্ড) শব্দ এসেছে ৬ বার, চতুর্থ উপাদান ‘মোগদা’ (মাংসপিন্ড) এসেছে ৩ বার। পঞ্চম উপাদান হচ্ছে ‘লাহম’ (হাড়), এটি এসেছে ১৫ বার। সর্বশেষ উপাদান হচ্ছে- ‘লাহম’ (গোশত), এ শব্দটি এসেছে ১২ বার। কোরআনে উল্লিখিত (সুরা হজ ৫)- এ উপাদানগুলো যোগ করলে যোগফল হবে ঠিক ৬৫। আর এসব উপাদান দিয়ে যে ‘ইনসান’ বানানো হয়েছে তাও কোরআনে ঠিক ৬৫ বার উল্লেখে করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা কোরআনের সুরা ‘আল ক্বামার’- এর প্রথম যে আয়াতটিতে চাঁদ বিদীর্ণ হওয়ার সঙ্গে কেয়ামতের আগমন অত্যাসন্ন কথাটি বলেছেন, আরবি বর্ণমালার আক্ষরিক মান হিসাব করলে তার যোগফল হয় ১৩৯০, আর এ ১৩৯০ হিজরি (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ) সালেই মানুষ সর্বপ্রথম চাঁদে অবতরণ করে, জানি না এটা কোরআনের কোন মোজেযা, না তা এমনিই এক ঘটনাচক্র, কিন্তু আল্লাহতায়ালার এ মহান সৃষ্টিতে তো ঘটনাচক্র বলতে কিছুই নেই। এ কারণেই হয়তো মানুষের চাঁদে অবতরণের সালের সঙ্গে কোরআনের আলোচ্য আয়াতটির সংখ্যামানের এ বিস্ময়কর মিল আমরা দেখতে পাই।