সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ স্বীয় মেহেরবানিতে আমাদেরকে মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমান হিসেবে জন্ম দান করেছেন। ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমান শ্রেষ্ঠ জাতি এবং ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। ইসলাম মানলেই ইহকালে শান্তি এবং পরকালে মুক্তি। যারা ইসলাম মানে না, পরকালে তো শান্তি নেই-ই, ইহকালেও শান্তি নেই।
দুনিয়াতে কাফের-মুশরিকদের আরাম-আয়েশে দিনাতিপাত করতে দেখা যায়, এটা আসলে শান্তি নয়। অশান্তির দাবানল তাদের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলছে, এটা দেখা যায় না। তাদের বিত্ত-সম্পদ আছে। গাড়ি-বাড়ি আছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। ক্ষমতা-রাজত্ব আছে। আরাম-আয়েশের সবরকম উপকরণ আছে। এগুলোকে কাফের-মুশরিকরা যেভাবে শান্তি মনে করে, কিছু দুনিয়াদার মুসলমানও তাই মনে করে। আর কাফেরদের মত দুনিয়াদার মুসলমানও এর পেছনে প্রাণপাত করে জীবনটা বিলীন করে দেয়। তারা বুঝতে পারে না, এগুলো শান্তি নয়, শান্তির উপকরণ মাত্র। উপকরণ কারও সংগ্রহে থাকলে তা দ্বারা শান্তি লাভ করা অনিবার্য নয়। উপকরণ দ্বারা শান্তি অর্জিত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আমরা দেখি, কেউ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খায়, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে আয়েশি উপকরণের মধ্যে বাস করে। তারপরও সে জটিল রোগে ভোগে। রাতে ওষুধ খেয়েও ঘুম হয় না। টেনশন অশান্তি আর পেরেশানি দূর হয় না। স্ত্রীর কাছে শান্তি পায় না। ছেলে-মেয়েদের কাছে শান্তি পায় না। লোকেরা সম্ভ্রমের নজরে দেখে না। এটা কি কোনো শান্তির জীবন হলো? গোটা দুনিয়ার আসবাব-উপকরণ আর ধন-দৌলত দিয়ে তার কী হবে?
আসল কথা হলো, তাদের কাছে মূল জিনিস অর্থাৎ ইসলাম নেই। ইসলাম অর্থ শান্তি। ইসলাম মানলে উভয় জাহানে মিলে শান্তি ও মুক্তি। আমরা শান্তির ধর্মের অনুসারী। আমরা মুসলমান। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা মুসলমানদের অশান্তির মধ্যে জীবন যাপন করতে দেখি। বিপদ-মসিবত ও নানা সঙ্কটে পেরেশান ও ব্যতিব্যস্ত দেখি। দেখি শৌর্য-বীর্যহীন, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অপমানিত জাতি হিসেবে। কিন্তু কেন? এর কারণ কী?
এককালে মুসলমানরা প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল। প্রায় পুরো পৃথিবীর শাসক ছিল। কুফরিশক্তি তাদের ভয়ে থরথর করে কাঁপত। তাদের রাজ্যে শান্তি ছিল। ইনসাফ ছিল। পরস্পরে মায়া-মহব্বত ছিল। সাম্যের পরিবেশ সর্বত্র বিরাজমান ছিল। কিন্তু আজ এসব তাদের থেকে সরে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজ মুসলমানরা নিঃস্ব, রিক্ত। অপাংক্তেয়, উপেক্ষিত। কিন্তু কেন?
আসুন! আমরা এর আসল কারণ খোঁজার চেষ্টা করি আল্লামা ইকবালের ভাষায়। তিনি বলেন, ‘মুসলমানরা পৃথিবীতে একদিন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানী হয়েছিল কোরআনকে বুকে আঁকড়ে ধরে। কোরআন আনীত পবিত্র ধর্ম ইসলামের ওপর আমল করে। কিন্তু আজ তারা ধিকৃত উপেক্ষিত লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছে- কোরআন পরিত্যাগের কারণে। কোরআনে কারিমের ধর্ম ইসলামকে ব্যবহারিক জীবন থেকে বাদ দেওয়ার কারণে।’
আল্লামা ইকবালের মূল্যায়ন শতভাগ সঠিক। আমাদের সম্পর্ক কি কোরআনে কারিমের সঙ্গে আছে? কোরআনের ধর্ম ইসলামের সঙ্গে আছে? আমাদের সন্তানাদিকে সব শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করি; কিন্তু কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করি না। নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি শিক্ষা দেই না। পাক-নাপাক, হালাল-হারাম শিক্ষা দেই না। পর্দা-পুশিদা শিক্ষা দেই না। ইসলামি কালচার ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেই না। তাহলে ইসলামের ওপর আমল করলাম কিভাবে? ইসলামকে মানলাম কিভাবে? এই যে পরবর্তী প্রজন্ম এভাবে বেড়ে ওঠছে- দেখলে চিনবার কোনো উপায় থাকে না সে মুসলমান না বিধর্মী। নামেও চেনা যায় না সে কোন্ ধর্মের লোক। এজন্য দায়ী কারা? ইসলামের শান্তির পথ পরিত্যাগ করলে ভাগ্যে আর কী জুটবে অশান্তি ছাড়া?
এজন্য দায়ী আমি-আপনি-আমরা সবাই। কাল কিয়ামতে আল্লাহর সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দায়িত্ব এড়ানোর কোনো চেষ্টা সফল হবে না। আমাদের সন্তানেরা আল্লাহর দরবারে আমাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবে। আজ গান-বাজনা হয়। মেলা কুস্তিখেলা ও ঘোড়দৌড়ের নামে মদ-জুয়ার আসর বসে। আমরা সমাজের বড়রা এর তত্ত্বাবধান করি, আশ্রয় দেই, সাহায্য-সহযোগিতা করি। পক্ষান্তরে ইসলামের কাজে, ভালো কাজে, জনসেবায়, মাদরাসা-মসজিদের কাজে আমাদের মুষ্ঠি খোলে না। উপরন্তু বিরূপ সমালোচনা করি। তাহলে ভালো ও কল্যাণকর জিনিস, নীতি-নৈতিকতা, ইসলামি মূল্যবোধ ও সুস্থ পরিশীলিত সাংস্কৃতিক আবহ সমাজে গড়ে ওঠবে কিভাবে? নতুন প্রজন্মই বা কী শিখবে? আর যা শিখবে, তাদের সফর কোন দিকে হবে? তাদের এ উচ্ছন্নে যাওয়া- এ বিপথগামিতার জন্য আমরাই দায়ী। কোনোভাবেই এ দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারব না। আল্লাহর দরবারে দেবার মত কোনো জবাব থাকবে না। বাঁচব কিভাবে- যে কোনোভাবেই বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু মরব কিভাবে, মরণের পর কী হবে- এটাই আসল চিন্তার বিষয়।
আসুন আমরা চিন্তা করি। ইসলামসম্মত জীবন নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। আখেরাতে জবাবদিহিতার ভয় হৃদয়ে সঞ্চার করি। একই সঙ্গে সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন ও সমাজ-সংসারকে নিয়ে ইসলাম শেখার জন্য তৎপর হই। ইসলামের ওপর মজবুতির সঙ্গে আমল করি। পরিবার ও ঘর-সংসারে ইসলামের হাওয়া ও ভাবধারা চালু করি। সন্তানাদিকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা দান করি। মানুষ বানানোর মেহনত করি। এভাবে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হলে, ইনশাআল্লাহ সেই হারানো সুদিন আবারও ফিরে আসবে।