রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য মহামূল্যবান। এই মাস প্রাপ্তিতে পরকালীন চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য মুমিনমাত্রই অবিমিশ্রিত আমল করে। প্রথম ১০ দিনে আল্লাহর রহমতে বান্দা নিজেকে সিক্ত করে নেয়, দ্বিতীয় ১০ দিনে ক্ষমা লাভের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়, আর শেষ ১০ দিনে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা লাভের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে।
এ জন্য মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনের প্রতি অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং নানা নফল ইবাদতের দ্বারা শেষ ১০ দিনকে সমৃদ্ধ করেছেন। রমজানের শেষ দশক হলো এ মাসের সবচেয়ে গুরুত্ববহ সময়। এ সময়ে নবী কারিম (সা.)-এর ইবাদত-বন্দেগি হতো বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমনকি রমজানের প্রথম বিশদিন থেকেও আলাদা বোঝা যেতো শেষ দশদিনের ইবাদত-নিমগ্নতা। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে এতো ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না। -সহিহ মুসলিম : ১১৭৫
তিনি আরও বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসতো নবী কারিম (সা.) তখন ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন, নিজে রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন।’ -সহিহ বোখারি : ২০২৪
আমাদেরও রমজানের শেষ দশকে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া চাই, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে। কারণ এ রাতগুলোতেই আছে হাজার বছরের সেরা রাত লাইলাতুল কদর, যা কোরআন নাজিলের মতো মহাঅর্জনসমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও ইহতিসাবসহ কদর রাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাল, তার আগের জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি : ১৯০১
লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান
রমজানের শেষ দশকে শান্তির বার্তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদর)। আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রূহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ -সুরা কদর : ১-৫
বায়হাকির শোয়াবুল ঈমানে হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন কদর রাত আসে, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট বাহিনীসহ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আল্লাহর জিকির ও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা প্রত্যেক বান্দার জন্য রহমতের দোয়া করেন। এই হাদিস হতে কদর রাতের মর্যাদা এবং এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি, কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ ও ইসলামি আলোচনা ও জ্ঞানচর্চার মর্যাদা স্পষ্টভাবে জানা যায়। শেষ দশকের ইবাদতের অন্যতম হলো- শবেকদর তালাশ করা। নবী কারিমে (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কদর রাতের সন্ধান পেতে চায় সে যেন রমজানের শেষ দশকে খুঁজে নেয়।’ -সহিহ বোখারি : ১১৫৮
নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের তালাশ করো।’ -সহিহ বোখারি : ২০১৭
অন্য হাদিসে ইরশাত হয়েছে, ‘কদরের রাত হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। যে এর কল্যাণ অর্জন পারে না, তার সব কল্যাণই হাতছাড়া হয়। সত্যিকার হতভাগা ছাড়া আর কেউ এর কল্যাণ বঞ্চিত হয় না।’ -ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪
শবেকদর নির্দিষ্ট না হলেও অধিকাংশ মানুষ রমজানো ২৭তম রাতকে কদরের রাত হিসেবে গ্রহণ মনে করে। কারণ হজরত বিলাল (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.) সহ বেশিরভাগ সাহাবার বর্ণনা সপ্তবিংশ রাতকে নির্দেশ করে। তবে আল্লাহর রাসুল (সা.) উম্মাহর কল্যাণার্থে নির্দিষ্ট করে দেননি। তাই আমরা সব বেজোড় রাতে আল্লাহর রাসুলের শিখিয়ে দেওয়া দোয়া দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইব।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) নবীজিকে বললেন, যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তাহলে কী দোয়া করবো? নবীজি শেখালেন এই দোয়া ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি।’ অর্থাৎ : ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী, ক্ষমা করতে আপনি পছন্দ করেন। অতএব আমায় ক্ষমা করুন।’ -সুনানে তিরমিজি : ৩৫১৩
শেষ দশকে ইতেকাফ
ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করল, আল্লাহপাক তার ও দোজখের মধ্যখানে এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব থেকেও বেশি।’ -সুনানে তিরমিজি
নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক ইতেকাফের সওয়াব হচ্ছে, দুইটি হজ ও উমরার সমপরিমাণ।’ -বায়হাকি
লাইলাতুল কদরের কল্যাণ যেনো আমাদের ছুঁয়ে যায়। তাই নবীজি (সা.) শেষ দশকে ইতেকাফের আমল দিয়েছেন। গুরুত্বের সঙ্গে অন্যকেও আমল করে শিখিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘নবীজি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ -সহিহ বোখারি : ২০২৫
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন, আর বলতেন, তোমরা এই দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ -সহিহ বোখারি : ২০২০
‘ইতিকাফ’ তথা ইবাদত-বন্দেগির নিমিত্তে নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান নেওয়া খুবই মহামূল্যবান আমল। এটি এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল যে আল্লাহর রাসুল (সা.) হজরত উমর (রা.) কে জাহিলি যুগের ইতিকাফের মানত ইসলাম গ্রহণের পর পূরণ করতে বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম (সা.) ইন্তেকাল অবধি প্রতি বছর ইতিকাফ করেছেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীরাও ইতিকাফ পালন করতেন। -সহিহ বোখারি : ২০২৬
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি ওফাতের বছরে বিশ দিন ইতেকাফ করেন। -সহিহ বোখারি : ২০৪৪
সদকাতুল ফিতর আদায়
শেষ দশকের অন্যতম আমল সদকাতুল ফিতর আদায় করা। সামর্থ্যবান প্রত্যেক নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার জন্য রাসুল (সা.) এটা ওয়াজিব করেছেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ করেছেন, যেন তা ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বেই আদায় করা হয়।’ -সহিহ বোখারি : ১৫০৩
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন, যাতে করে এটা রোজাদারের রোজার বিচ্যুতি তথা অনর্থক কথা-কাজ ও অশালীন আচরণের ক্ষতিপূরণ হয় এবং অসহায় মানুষের খাবারের সুন্দর ব্যবস্থা হয়।’ -সুনানে আবু দাউদ : ১৬০৯
হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘নবীজির যুগে আমরা ঈদুল ফিতরের দিনে খাদ্যদ্রব্যের এক সা’ অথবা এক সা’ যব, অথবা এক সা’ খেজুর, অথবা এক সা’ পনির, অথবা এক সা’ কিশমিশ সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ -সহিহ বোখারি : ১৫০৫
সদকাতুল ফিতর আদায়ে সামর্থ্যবানদের উচিত ফিতরার সর্বনিম্ন হারকে নিজেদের জন্য গ্রহণ না করে ফিতরার উচ্চ হারগুলো প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে করে সমাজের অসহায় মানুষরা বেশি লাভবান হয়। হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (রহ)-এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা উত্তম। ইমাম শাফিঈ (রহ)-এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উত্তম। অন্যসব ইমামের মতও অনুরূপ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মতে, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। এছাড়া সদকার ক্ষেত্রে সব ফকিহর ঐকমত্য হলো, ‘যা গরিবদের জন্য বেশি উপকারী।’ -আল মুগনি : ৪/২১৯
বিভিন্ন দামের খাদ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা উন্নতমানের চাল অথবা তৎমূল্যে ফিতরা আদায় করা উত্তম। ধনীরা সর্বোচ্চ এবং সাধারণেরা মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো, যারা যে চালের ভাত খান বা যারা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তারা ওই সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তা-ই উত্তম, দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ -সহিহ বোখারি : ৩/১৮৮
চলতি বছর বাংলাদেশে ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩১০ টাকা ও সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য, পণ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্যকোনো বস্তু (যেমন পোশাক-আশাক, ঈদের বাজার প্রভৃতি) কিনেও দেওয়া যায়। মাতা-পিতা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন স্ত্রী ও পোষ্য), তাদের ওয়াজিব ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায় না।
আমাদের উচিত, গোটা রমজান, বিশেষ করে শেষ দশকের প্রতিটি দিন রোজা আর রাতগুলো কিয়াম তথা তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকারের মধ্য দিয়ে কাটানো, যাতে আল্লাহর মাগফিরাতসহ সন্তুষ্টি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হয়ে জান্নাত লাভ করা যায়।