লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রজনী। লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোর মধ্যে কোন এক বেজোড় রাত লাইলাতুল কদর। আল্লাহপ্রেমে সিক্ত হওয়া, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত অর্জনের এক বিশেষ সুযোগ রয়েছে এ রাতে।
‘শবে কদর’ শব্দটি ফারসি। শব অর্থ রাত বা রজনী আর কদর অর্থ মহিমান্বিত, সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। শবেকদর অর্থ মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবেকদরের আরবি লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। যে রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, সে রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ জিবরাইল (আ.)-সহ অবতরণ করেন, তাদের প্রভুর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত।’ -সুরা কদর : ১-৫
শবেকদরে সৃষ্টজীবের পূর্ণ এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেক প্রাণির রিজিক ও জীবিকাসহ সর্বপ্রকার কাজ-কর্ম নির্ধারণ করা হয় বলে এই রাতকে লাইলাতুল কদর বা পরিমাপ নির্ধারণী রাত বলা হয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ -সহিহ বোখারি
এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। ফেরেশতাগণ এবং জিবরাঈল (আ.) এ রাতে জমিনে অবতরণ করেন। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না। -ইবনে মাজাহ
মহিমান্বিত এই রাতে রাব্বে কারিম সমস্ত কুমন্ত্রণা, শয়তানি ধোঁকা অকার্যকর রকে রাখেন। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘শয়তান এ রাতে কাউকে ক্ষতি বা রুগ্ন করতে পারে ন, অথবা কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে না এবং কোন জাদুকর তার জাদু কার্যকর করতে পারে না।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন।’ কারও কারও মতে, ‘আল্লাহ এ বছরে যে সব বিষয়ের নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহকারে ও সওয়াবের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে (রাত্ জাগরণ করবে), তার পেছনের সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ -সহিহ বোখারি
হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এই তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (২৬ রমজানের দিবাগত রাতে) শবেকদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসুল (সা.) এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি; বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন।
মহিমান্বিত এ রাতকে আল্লাহ রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লুকিয়ে রেখেছেন। বান্দা বিনিদ্র্র রজনী কাটাবে, সবর করবে এর মধ্যে খুঁজে পাবে সম্মানিত রাত, পাবে রহমত ও মাগফিরাত; ফেরেশতার অদৃশ্য মোলাকাতে সিক্ত হবে তার হৃদয়, আপন রবের ভালোবাসায় হবে সে উদ্বেলিত। এ যেন দীর্ঘ বিরহের পর আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। এ দীর্ঘ প্রতিক্ষার কষ্ট-বিরহের মাধ্যমে রব তার বান্দাকে আরও আপন করে নেন।
হাদিসে শবেকদর নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে বুজুর্গ আলেমরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, ওই রাতের আবহাওয়া হবে প্রশান্তিময়। রাতটি হবে খুবই শান্ত। রাত শেষে সকালটি হবে প্রশান্তির। এ রাতে প্রত্যেক বস্তুকে সেজদারত অবস্থায় দেখা যাবে। প্রতিটি স্থান হবে বেহেশতি আলোয় আলোকিত। সবচেয়ে সুস্পষ্ট নিদর্শন হচ্ছে, এই রাতের ইবাদত অন্তরে তৃপ্তি জোগাবে।
শবেকদর দোয়া কবুলের রাত। এই রাতে আল্লাহ আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। তাই এ রাতে বেশি বেশি দোয়া করা। নিজের পাপমুক্তির পাশাপাশি বৈধ প্রয়োজন পূরণের জন্য দোয়া করা। নিজের জন্য, নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সমগ্র মুসলমানের জন্য দোয়া করা।
মহিমান্বিত এ রাতে নফল নামাজ, সালাতুত তাসবিহ, তওবার নামাজ, সালাতুল হাজত পড়া। সম্ভব হলে নামাজে কেরাত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। কোরআন তিলাওয়াত করা। দরুদ বেশি বেশি পড়া, কারণ দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা। দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার করা। কবর জিয়ারত করা।