‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’

, ইসলাম

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 21:23:40

পবিত্র আশুরা আজ। মহররম মাসের ১০ তারিখ। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ কাছে ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত এক গভীর শোকাবহ দিন। এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চক্রান্তকারী স্বৈরতন্ত্রী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে কারবালা প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে শাহাদতবরণ করেন। দিনটি একদিকে শোকের ও বেদনার, অন্যদিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের চেতনায় সমুজ্জ্বল।

ইসলামের ইতিহাসে মহররমের ১০ তারিখে কারবালা প্রান্তরে পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথিসহ হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতবরণের মর্মান্তিক ঘটনার আগেও এই তারিখে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বিশ্ব ইতিহাসে। আদি মানব হজরত আদম (আ.) এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন, তাঁর তওবা কবুল হয় এই দিনেই। এই দিনে হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পায়।

এসব ঐতিহাসিক ঘটনার তালিকায় মর্মান্তিক বেদনার আবহ সঞ্চারিত করে কারবালার নৃশংসতা। আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং এ জন্য ষড়যন্ত্র ও বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেন। খেলাফত বা শাসনের আরেক বৈধ উত্তরাধিকারী, মহানবী (সা.)-এর আরেক দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.)-কে আগেই বিষপানে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন ও ৭২ জন সঙ্গীসহ শাহাদতবরণ করেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। এই হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত নির্মম। অসহায় নারী ও শিশুদের পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি পাষণ্ড ইয়াজিদ বাহিনী।

কারবালার ঘটনার পর থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বব্যাপী আশুরা পালিত হয় মহররমের ১০ তারিখ। ধর্মীয় ভাবাবেগ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে স্মরণ করা হয় নবীবংশের সম্মানিত সদস্যগণে আত্মত্যাগের গৌরবময় ঘটনাক্রম, যার মূল বক্তব্য সত্যের পথ অনুসরণ করার ও ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করার অনুপ্রেরণায় দীপ্ত।

ফলে আশুরার মূল চেতনা হলো, অসত্য, স্বৈরতন্ত্র, অবৈধ কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে সাময়িক আঘাত এলেও চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। এজন্যই দার্শনিক কবি বলেছেন, "কাতলে হোসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়,/ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ।’" অর্থাৎ, হোসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা আসলে ইয়াজিদেরই মৃত্যু, ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়।

ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন, “মুসলমানের জন্য প্রতিটি ভূমিই কারবালা আর প্রতিটি দিন হচ্ছে আশুরা।”

ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্যে আশুরা ও কারবালার ঘটনা বিরাট জায়গা জুড়ে উপস্থিত। বাংলা ভাষায় কাজী নজরুলের কবিতা এবং মীর মোশাররফ হোসেনের কালজয়ী 'বিষাদ সিন্ধু' যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

অন্যান্য ধ্রুপদী ভাষা, যেমন আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজিতে কারবালার আখ্যান বার বার লিপিবদ্ধ করেছেন বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিকগণ। যাদের মধ্যে আধুনিককালের
মাওলানা মোহাম্মাদ আলী জাওহার এবং আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ছাড়াও রয়েছেন ইতিহাসখ্যাত কবি জালালুদ্দিন বলখি রুমি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, আবদুর রহমান জামি প্রমুখ। বিশেষত, ইকবালের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়, নবীবংশ তথা আহলে বাইতের প্রতি, ইমাম হোসেইনের আত্মত্যাগের প্রতি তাঁর প্রেম, ভালোবাসা ও ভক্তি অম্লান।

মহররমের শিক্ষা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে। তাঁর ভাষায়, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’। অর্থাৎ, মহররম মাসে আশুরার চেতনায় অন্যায়-অবিচার ও ষড়যন্ত্র থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখতে কান্নাকাটি বা বিলাপ নয়, ত্যাগের মহিমা উজ্জীবিত হওয়াই কর্তব্য, কবির এই বক্তব্য এক শাশ্বত সত্যের প্রতিধ্বনি স্বরূপ। আশুরা মূলত ন্যায়, সত্য, কল্যাণের পক্ষে এবং অন্যায়, অসত্য ও স্বৈরতার বিপক্ষে সুদৃঢ় চিত্তে অবস্থান গ্রহণের অনিঃশেষ প্রেরণা প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে জাগ্রত করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর