ইসলাম সমাজকল্যাণমূলক ধর্ম। মানব ও সমাজকল্যাণ ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। ইসলাম ও সমাজকল্যাণ একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবকল্যাণে করা সব কাজ ইসলামে ইবাদত হিসেবে গণ্য। শর্ত হলো, তা নিঃস্বার্থ মানবসেবা হতে হবে। সেবক বিশ্বাস করবে, এর মাধ্যমে দয়াময় আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করব। তার কাছ থেকেই প্রতিদান পাব। কোনো ধরনের সুনাম ও সুখ্যাতির আশা আমার নেই। প্রতিটি এমন কাজ- যা চিন্তিত ব্যক্তির চিন্তা, বিপদগ্রস্তের বিপদ, আহতের ক্ষত, বঞ্চিতের অধিকার, মজলুমের জুলুম, পরাভূত ব্যক্তির পরাজয় দূর করার উদ্দেশ্যে হয়- তাই ইবাদত।
পৃথিবীতে কল্যাণ ও হিতকর একটি কাজ সেবা। সেবার বিভিন্ন খাত থাকলেও সমাজসেবা অন্যতম। মানবজীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সমাজসেবা সীমাহীন গুরুত্বের দাবিদার। সাধারণত সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত নিম্নশ্রেণির মানুষের কল্যাণে গৃহীত সেবামূলক কার্যক্রমকে সমাজসেবা বলা হলেও আধুনিক ধারণামতে, সমাজসেবা হচ্ছে- সমাজে মানুষের নিরাপত্তা ও মঙ্গলার্থে গৃহীত যাবতীয় কার্যক্রমের সমষ্টি।
ইসলামে সমাজসেবার পরিধি আরও ব্যাপক। শুধু তা-ই নয়, সমাজসেবা হচ্ছে- ইসলামি দাওয়াতের ভূমিকাস্বরূপ। হজরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজসেবার মাধ্যমে আরবের জনমানুষের হৃদয় ও মন জয় করেছিলেন- যা নবুওয়তপ্রাপ্তির পর দাওয়াতি কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
‘হিলফুল ফুজুল’ নামে কল্যাণ সংস্থার সেবাকর্ম দ্বারা নবী কারিম (সা.) এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, লোকেরা তাকে ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। নবীর সেবাধর্মী চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন। মেহমানের সমাদর করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ –সহিহ বোখারি
তবে শর্ত একটাই, মানবসেবা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আদর্শকে সামনে রেখে চালিয়ে যেতে হবে। বান্দার হক তথা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও গরিব-দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং আর্তমানবতার সেবা, সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দরিদ্র, নিঃস্ব, এতিম, নিরাশ্রয়, রোগী ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে যথাযথ সেবা করা খুবই সওয়াবের কাজ। আর এতে অমনোযোগী হওয়া আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও গোনাহর কাজ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে গুরুত্ব সহকারে তাকিদ দেওয়া হয়েছে।
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তার সঙ্গে শরিক করবে না এবং বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না- যারা কৃপণতা করে, মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন, তা গোপন করে।’ -সুরা নিসা : ৩৬-৩৭
ইহকালের শান্তি ও পরকালে মুক্তির জন্য প্রত্যেকেরই সাধ্যমতো সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে। সমাজসেবায় যেসব কাজ করা যেতে পারে-
দানবীর ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে জাকাত, ওসর, ফেতরা, কোরবানির চামড়া ও ত্রাণসামগ্রী কিংবা আপদকালীন ব্যয় বাবদ অর্থ আদায় করে বিশেষ তহবিলে জমা করে প্রয়োজনমতো খরচ করা।
জনগণের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ- শরিয়তসম্মত উপায়ে সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করা। পাশাপাশি আইন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করে এর মাধ্যমে ন্যায্য অধিকার রক্ষায় বিচারপ্রার্থীকে আইনি সহায়তা দেওয়া।
মানবসেবায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান ও সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শেখানো ও দৈনন্দিন জীবনের জরুরি মাসায়ালা-মাসায়েল শেখানোর ব্যবস্থা করা।
গ্রামগঞ্জের মানুষের সবসময় কাজ থাকে না। এমন একটি মাস বেছে নিয়ে কোনো মসজিদে মাসব্যাপী বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা। মাগরিব বা এশার নামাজের পরে সম্ভব হলে সপ্তাহে, প্রতিদিন অথবা অন্তত তিন বা চার দিন ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। নিজেদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞ কোনো দায়িত্বশীল ক্লাস নেবেন অথবা অন্যকোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়েও ক্লাস নেওয়া যেতে পারে।
সমাজের মানুষের উপকারের নিয়তে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে অসহায় রোগীদের মধ্যে ফ্রি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা করা যেতে পারে। স্বল্প খরচে হোমিওপ্যাথি ওষুধপথ্যের সাহায্যে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করা যায়। তাছাড়া রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানোসহ চিকিৎসকরা ফ্রি-ফ্রাইডে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই এ কাজ করা সম্ভব।
এমনকি বৃক্ষরোপণও একটি উত্তম সেবা, সওয়াবের কাজ। রাস্তার পাশে ও পতিত জমিতে গাছ লাগিয়ে সৃষ্টিকুলের খেদমত করা যায়।
আগেই বলা হয়েছে, সমাজসেবা একটি ইবাদত। এ সেবার মাধ্যমে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষের মতো অধঃপতিত কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। তাছাড়া এ সেবা কার্যক্রম প্রত্যেকেই চালিয়ে যেতে পারে। আইনজীবীরা আইন মারফত মজলুমের সাহায্য করে, তাদের মামলা-মোকদ্দমায় বিনা পারিশ্রমিকে সহায়তা করতে পারে। ডাক্তাররা প্রাথমিক ওষুধপথ্যের মাধ্যমে এবং ফ্রি চিকিৎসা ও অতিরিক্ত ফি না নিয়ে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে। এ রকম প্রতিটি সেক্টর থেকেই নিজ নিজ পরিসরে এ মহান সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।