বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণে ইসলামের প্রভাব প্রকটভাবে কাজ করেছে। এ অঞ্চলে ইসলামের আগমনের সূচনা হয় ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকেই। তবে আরব বণিকদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলামের খবর ইতিপূর্বেই এসে যায়। সেসব বণিকের বাণিজ্য নৌ-জাহাজ সুদূর চীন-সুমাত্রা অঞ্চল পর্যন্ত যাতায়াত করত বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ছুঁয়ে। সেসব জাহাজে দূরপ্রাচ্যে ইসলাম প্রচার করতে যেসব সাহাবায়ে কেরাম যেতেন তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর এলাকায় সফর বিরতি দিয়ে এখানকার মানুষের সামনে ইসলামের সুমহান বাণী তুলে ধরতেন। তবে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালের (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) মধ্যভাগে।
ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এজন্য পাড়ি দিতে হয় অনেক প্রতিকূল পথ, সহ্য করতে হয় কষ্ট, বিলাতে হয় স্বাধীনতাকামীদের রক্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি কোনো ইতিহাসজ্ঞ ব্যক্তিরাই অজানা নয়। ১৯৭০ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে তার মেনিফেস্টোতে কোরআন-সুন্নাহর বিরোধী কোনো আইন পালন না করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে।
নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছিল, ‘৬-দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে, সেই মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মতো আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোনো কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামি নীতির পরিপন্থি কোনো আইনই এ দেশে পাস হতে বা চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না।’ -বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, নুহ-উল-আলম লেনিন সম্পাদিত, সময় প্রকাশন, ২০১৫, পৃ. ২৬৫
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণে ‘লেবেলসর্বস্ব ইসলাম নয়’ অংশে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য-লেবেলসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী, ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে কারিম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, লাঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন; আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা শায়েস্তা করার জন্য।’ -বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, নভেল পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ.২১
তাছাড়া আমরা লক্ষ করি, সব আন্দোলনেই ইসলামের প্রভাব সক্রিয় ছিল। যেমন-মওলানা ভাসানীর ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা, ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর ‘লাকুম দীনুকুম ওলিয়াদীন’ বলা, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রবাস থেকে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইশতিহার ও নির্দেশাবলিতে ‘আল্লাহ আমাদের সহায়’, ‘নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব’ প্রভৃতি লেখার মাধ্যমে ইসলামের বৈপ্লবিক চেতনার প্রকাশ ঘটে।
১৯৭১ সালে ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র চার দিন পর প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশাবলি পত্র দেওয়া হয়। এই নির্দেশাবলি পত্রের শীর্ষেই লেখা হয় ‘আল্লাহু আকবার’ তারপর স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করে বলা হয়- ‘বাঙালির অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙালির অপরাধ তারা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিদের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে, বাঙালির অপরাধ আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীতে আল্লাহর নির্দেশ মতো সম্মানের সঙ্গে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙালির অপরাধ মহান স্রষ্টার নির্দেশ মতো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষণা করেছে।
আমাদের সহায় পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য। মনে রাখবেন, আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দুশমন বাঙালি মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে, বাড়ি-ঘর লুট করতে, আগুন জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদের মিনারে আজান প্রদানকারী মুয়াজ্জেন, মসজিদ গৃহে নামাজরত মুসল্লি, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। .... এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অটল থাকুন। স্মরণ করুন! আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর।’ বিশ্বাস রাখুন ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।’ -বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৯-২২
উপরোক্ত নির্দেশাবলিটি ছিল সাধারণ জনগণের উদ্দেশে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম নির্দেশনামা। নির্দেশনামাটির শীর্ষে লেখা ছিল- ‘আল্লাহু আকবার’ এবং শেষ হয়েছিল এই বলে- ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।’ এ নির্দেশনামা বিশ্লেষণ করলে ইসলামের প্রতি, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের বিষয়টিই স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনা বলে স্বীকৃত হয়।
এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রতিদিন পবিত্র কোরআন মাজিদ ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করা হতো। এসব পরিপ্রেক্ষিতই বলে দেয় তিন লাখ মসজিদের এদেশ তার স্বাধীনসত্তা মূলত লাভ করেছে ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রভাবে।