জাপানে বিভিন্ন দেশের নানা ধর্মের অনুসারী প্রবাসীদের বসবাস বাড়তে থাকায় সমাধিক্ষেত্র নিয়ে সংকট দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে কবর সংকটে মৃত স্বজনদের লাশ দাফন নিয়ে চিন্তিত জাপানের মুসলিমরা।
কর্মসংস্থানের সুবিধা বাড়ায় জাপানে এশিয়ার অনেক মুসলিম দেশ থেকে প্রবাসীদের বসবাস গত কয়েক বছরে বেড়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বাংলাদেশি আছেন ১৭ হাজারের মতো। ইন্দোনেশিয়ান ৬৬ হাজার। আর পাকিস্তানি আছেন প্রায় ১৮ হাজার। এ ছাড়া জাপানের নাগরিকসহ দেশটিতে লাখ দু’য়েক মুসলিম নাগরিকের বাস।
জাপানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি, জাপানি নাগরিকদের মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগই লাশ বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা শিন্তো রীতি অনুযায়ী পুড়িয়ে ফেলে। কাজেই মুসলিমরা সেখানে কিছু বিধি-নিষেধের মধ্যে আটকে গেছে। ইসলামে লাশ পোড়ানোর বিধান নেই। মুসলিমরা সাধারণত তাদের লাশ মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাফন করে থাকে।
এমতাবস্থায় জাপানের অনেক পরিবার লাশকে যথাযথভাবে ইসলামি রীতি অনুযায়ী কবর দেওয়ার জন্য শত শত কিলোমিটার দূরে যেতে বাধ্য হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে পরিস্থিতির কথা বিবিসিকে বলছিলেন তাহির আব্বাস খান বলছিলেন, ‘তারপরও আমার নিকটাত্মীয় কাউকে হয়তো মৃত্যুর পর পুড়িয়ে ফেলা হতে পারে, এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।’
তাহির আব্বাস ২০০১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য জাপানে যান। পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত এই ব্যক্তি এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং জাপানের নাগরিক। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ সক্রিয় এবং তিনি বেপ্পু মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলেন, ‘শেষকৃত্য হচ্ছে কোনো একটি মানুষের জন্য আপনি সর্বশেষ যা করতে পারেন সেই কাজ। আমি যদি আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুকে মর্যাদাপূর্ণভাবে দাফন করতে না পারি, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবো না।’
২০০৯ সালে দক্ষিণাঞ্চলের কিয়ুশু দ্বীপের ওইতা এলাকায় প্রথম মসজিদ স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেখানে থাকা প্রায় ২ হাজার মুসলিমের জন্য একটি কবরস্থান বানানোর প্রক্রিয়া এখনও পরিকল্পনা পর্যায়েই আটকে রয়েছে।
মুহাম্মদ ইকবাল খান ২০০৪ সালে পাকিস্তান থেকে তার স্ত্রীর সঙ্গে জাপানে এসেছিলেন। টোকিওর কাছে তিনি একটি গাড়ি রফতানির ব্যবসা গড়ে তোলেন। পরে তিনি তার ব্যবসা পাশের ফুকুয়া শহরে স্থানান্তরিত করেন। যখন তার স্ত্রী ২০০৯ সালে একটি মৃত শিশুকে জন্ম দিলেন, তখন ওই এলাকায় মুসলিমদের জন্য কোনো কবরস্থান ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খান বলেন, ‘আমরা লাশটি একটি ছোট বাক্সে ঢুকিয়ে গাড়িতে তুলি। তারপর গাড়ি চালিয়ে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে ইয়ামানাশিতে নিয়ে যাই।’
জাপানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত ইয়ামানাশি সমাধিস্থল খ্রিস্টান ও মুসলিমরা ব্যবহার করে। খ্রিস্টানরাও জাপানের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। দেশটির জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের কিছু বেশি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
তবে অবস্থা পাল্টাতে চলছে নানাবিধ পরিকল্পনা। ড. তাহির আব্বাস খানের সংস্থা বেপ্পুতে খ্রিস্টান সমাধিস্থলের পাশে একটি জমি কেনে। জমির পাশে যাদের জমি ছিল তারা ‘অনাপত্তিপত্র’ দিলেও তিন কিলোমিটার দূরে বসবাসরত একটি সম্প্রদায় এতে আপত্তি জানায়। ড. খান বলেন, ‘তারা বলে যে লাশ কবর দেওয়া হলে তা মাটির নিচের পানিকে দূষিত করে ফেলবে। এ ছাড়া লেকের পানি দূষিত হয়ে যাবে যা সেচকাজে ব্যবহার করা হয়। মূলত কবর দেওয়ার বিরোধিতার পেছনে ‘সাংস্কৃতিক কুসংস্কার’ কাজ করেছে।’
গত সাত বছরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। আর মুসলিম অভিবাসীরা পরিবারের সদস্যদের লাশ দেশে পাঠিয়ে দেয়। লাশ পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ জটিল কিন্তু শেষ কথা হলো, লাশ পাঠানো যায়। কিন্তু জাপানি মুসলমি নাগরিকদের জন্য তো তো সেই পথও খোলা নেই।
জাপানে মোট ১৩টি মুসলিম কবরস্থান রয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি একটি হিরোশিমায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি। হিরোশিমান কবরস্থানের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য পানির সরবরাহ রয়েছে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা হালাল খাবার পরিবেশন করে।
সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে আবেদন করেছেন তিনি। বর্তমানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বেপ্পুতে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক টুকরো জমির বরাদ্দ দিয়েছে যেখানে ৭৯টি দাফন করা সম্ভব। বিষয়টি একটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তিনি বলেন, ‘এটা শুধুমাত্র ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়, এটা মৌলিক মানবাধিকার। আমরা বিনামূল্যে কিছু চাইছি না। আমরা এর জন্য সানন্দে দাম দিতে রাজি আছি। কিন্তু অনুমোদন পাওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছোট ছোট অন্যান্য সম্প্রদায় যেমন ইহুদি আর ব্রাজিল থেকে আসা খ্রিস্টানরাও এই সমস্যার মুখে পড়েছে। তাই সহজ সমাধান হচ্ছে, জাপানের প্রতিটি অঞ্চলে বহু ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য একটি করে সাধারণ সমাধিস্থল তৈরি করা।’