পবিত্র রমজানের জন্য পরিকল্পনা করা, ব্যক্তিগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরি। রমজানে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো হতে হবে সুবিন্যস্ত ও স্পষ্ট। তাহলে রমজান সফল হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, রমজানের বরকত ও সওয়াব মিলবে। এজন্য কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
অভ্যাস পরিবর্তন কঠিন কিছু নয়
অনেকের ইচ্ছা থাকে, রমজানে নিজের কোনো নেতিবাচক অভ্যাস কিংবা জীবন থেকে নেতিবাচক কিছু ঝেড়ে ফেলার। এটি হতে পারে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্য কিংবা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের লক্ষ্য। এক্ষেত্রে আপনাকে বলব ভিন্ন কথা। রমজানে কোনো অভ্যাস ত্যাগ কিংবা পরিবর্তনের লক্ষ্যের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত- নতুন অভ্যাস গড়ার প্রতি। আপনার মন সেদিকে আকৃষ্ট হবে, যা নিয়ে আপনি চিন্তা করছেন। তাই যখন আপনার লক্ষ্যের কথা আপনি নেতিবাচক ভঙ্গিতে ভাববেন তখন আপনার মন তা করার প্রতিই বেশি আগ্রহী হবে।
সুতরাং ভাববেন না, ‘রমজানে ওজন ২০ কেজি কমাতে হবে।’ বরং ভাবুন, ‘রমজানের শেষে আমার ওজন ৭০ কেজিতে নিয়ে আসতে হবে।’ একইভাবে আপনি যদি ভাবেন, ‘এই রমজানে কোরআন খতম দিতে পারলে দেব, না হলে কী আর করা?’ তাহলে আপনার মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বরং ভাবুন, ‘এই রমজানে কোরআন মাজিদ খতম করতেই হবে।’
স্ব-প্রণোদিত হয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করা
রমজান নিয়ে আপনার লক্ষ্য হতে হবে প্রাসঙ্গিক। স্ব-প্রণোদিত হয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন। কারও কথায় আকৃষ্ট না হয়ে নিজের তাড়না থেকে লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।
মানুষ সাধারণত এমন সব লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যা পূরণ করা সহজেই সম্ভব। তবে রমজানে এমন করবেন না। একটু কঠিন লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। জীবনে আগে কখনো রমজানের প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ পড়েননি, প্রতিদিন এশার নামাজের পর সম্পূর্ণ তারাবির নামাজ পড়েননি, আগে কখনো ইতিকাফ করেননি- তাহলে এবার চেষ্টা করুন। রমজানে কাজগুলো করা সহজ, কারণ শয়তান শিকলবদ্ধ থাকে, চারদিকে প্রবহমান থাকে রমজানের সুশীতল বাতাস। তাছাড়া আমলের ফজিলতও অনেক বেশি। নবী কারিম (সা.) রমজানের শেষ দশকের নিজের কোমরবন্ধ শক্ত করে বেঁধে নিতেন এবং রমজানের আগের বিশ দিন যে পরিমাণ ইবাদত করতেন, শেষ দশ দিন তার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিতেন। আমাদের এভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার টার্গেট রাখতে হবে।
মনে করুন, রমজানে আপনি একবার সম্পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করার লক্ষ্য স্থির করলেন। তাহলে, প্রতিদিন এক পারা অর্থাৎ২০ পৃষ্ঠা তেলাওয়াত করতে হবে। তাহলে, আপনি দিনে ১০ পৃষ্ঠা আর রাতে ১০ পৃষ্ঠা তেলাওয়াত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন। অথবা প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৪ পৃষ্ঠা করে পড়তে পারেন। এভাবে সংখ্যাবাচক লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তা পূরণ করা সহজতর হবে।
পর্যালোচনা
রমজানে আপনার লক্ষ্য কতটুকু পূরণ করতে পারছেন, তা প্রতিদিন হিসাব নিতে হবে; আত্মপর্যালোচনা করতে হবে। তাহলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, কোথায় সমস্যা হচ্ছে এবং কোথায় আরও বেশি চেষ্টা চালাতে হবে। ইসলামি পরিভাষায় আত্মপর্যালোচনাকে মুহাসাবা বলে। হজরত হাসান (রহ.) বলেন, ‘মুমিন তার নিজের অভিভাবক। সে নিজেই নিজের হিসাব গ্রহণ করে। যারা দুনিয়াতে মুহাসাবা করেছে, আপন কৃতকর্মের হিসাব নিয়েছে, কেয়ামতের দিন তাদের হিসাব সহজ হবে। আর যারা মুহাসাবা ছাড়া জীবনযাপন করেছে, তাদের হিসাব কঠিন হবে।’ -হিলয়াতুল আউলিয়া : ২/১৫৭
নির্দিষ্ট লক্ষ্য
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, লক্ষ্য নির্দিষ্ট হওয়া। যেমন, আপনি রমজানে আপনার চরিত্র সুন্দর করতে চান। তা কীভাবে করবেন? কার সঙ্গে করবেন? চরিত্রের কোন কোন দিকগুলো সুন্দর করবেন? কোন কোন দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন এ ধরনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য রাখতে হবে।
কর্মসূচি
আপনি চাইলে রমজান ১০০ লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন। কিন্তু, আপনার হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকলে আপনি এর কোনোটাই পূরণ করতে পারবেন না। তাই এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আপনি প্রতিদিন ২০ পৃষ্ঠা কোরআন পড়বেন, ভালো কথা। এখন আপনি হিসাব করুন ১ পৃষ্ঠা তেলাওয়াত করতে কত সময় লাগে। এভাবে পরিকল্পনা করে নিতে হবে, প্রতিদিন তেলাওয়াতে কত সময় দিতে হবে।
লক্ষ্যগুলো লিখে রাখুন
ওপরে সংক্ষিপ্তভাবে যে দিক-নির্দেশনাগুলো দেওয়া হলো- এখন আপনি একটু সময় ব্যয় করে রমজানে আপনার নিজের জন্য ১৫টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা লিখে রাখুন। তারপর কিভাবে আপনি এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করবেন তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করুন।
ব্যক্তিসত্তা
লক্ষ্য সম্পর্কে লেখার সময় নিজের ব্যক্তিসত্তাকে উদ্দেশ্য করে লিখবেন। সম্পূর্ণ বাক্য নিজের লক্ষে লিখবেন এবং সরাসরি নিজেকে উদ্দেশ্য করে লিখবেন। যেমন, ‘প্রতিদিন ৪৫ মিনিট কোরআন পড়া’ না লিখে লিখবেন- ‘আমি প্রতিদিন ৪৫ মিনিট কোরআন তেলাওয়াত করব।’
বর্তমান কাল
এটি হচ্ছে আরেকটি দারুণ কৌশল। লক্ষ্যগুলো ভবিষ্যৎ কালে না লিখে বর্তমান কালে লিখুন। লক্ষ্য সম্পর্কে লেখার সময় ভাবুন যদি সেই লক্ষ্য পূর্ণ হয়ে যেত, তাহলে আপনি কী লিখতেন এবং সেই কথাই লক্ষ্যের জায়গায় লিখে ফেলুন। যেমন, ‘এই রমজানে ১০টি সুরা মুখস্থ করব’ না লিখে আপনি লিখুন; ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমতে এই রমজান শেষে আমি ১০টি সুরা মুখস্থ করে ফেলেছি।’ এভাবে লিখলে যতবারই আপনি আপনার লক্ষ্যগুলো পড়বেন ততবার আপনি অনুভব করবেন, এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে আপনার কত ভালো লাগবে। নিঃসন্দেহে এই কৌশল আপনাকে লক্ষ্য পূরণে অনুপ্রাণিত করবে।