ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা। পারিভাষিক অর্থ, যে ব্যক্তি মসজিদে অবস্থান করে এবং ইবাদতে মশগুল হয় তাকে বলা হয়- ‘আকিফ’ এবং ‘মুতাকিফ।’ অর্থাৎ ইতিকাফকারী।
শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ মানে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করা।
ইতিকাফ এমন একটি ইবাদত, যা পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)-এর সময় থেকে চলে আসছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনেও এর কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় খলিল হজরত ইবরাহিম (আ.) এবং হজরত ইসমাইল (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন কাবা ঘর নির্মাণের পর তাওয়াফ করতে এবং ইতিকাফকারী ও নামাজ আদায়কারীদের জন্য তা (আল্লাহর ঘর) পরিষ্কার রাখতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে হুকুম করি, তোমরা আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা (এখানে) তওয়াফ করবে, ইতিকাফ করবে এবং রুকু ও সিজদা আদায় করবে।’ -সুরা বাকারা : ১২৫
মূলত রমজান মাস হলো আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের বসন্তকাল এবং ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মৌসুম। যদিও এই মাস গোনাহগার ও নাফরমানদের জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাতের সুবর্ণ সুযোগের মাধ্যম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি নেক ও পরহেজগার ব্যক্তিদের জন্য রহমত, বরকত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল মাধ্যম। তাই আল্লাহতায়ালা রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের মতো মহান ইবাদতের বিধান রেখেছেন। এটি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একটি মহা উপহার।
যা পূর্ববর্তী নবী (আ.) থেকে সাহাবায়ে কেরামরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে আমল করে এসেছেন। শরিয়তে ইতিকাফ হলো- সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফ করা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি স্বতন্ত্র সুন্নত এবং এর চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে যে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা এর প্রতি যত্নবান ছিলেন। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, অনেক আমল তো নবীজি (সা.) কখনো করেছেন আবার কখনো ছেড়েও দিয়েছেন। কিন্তু মদিনায় হিজরত করার পর থেকে ওফাত পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফের আমলটি তিনি কখনোই ছেড়ে দেননি। অথচ বড়ই আশ্চর্য ও আফসোসের বিষয় হলো, এই মর্যাদাপূর্ণ আমলটির ব্যাপারে মানুষ তেমন গুরুত্ব দেয় না।
হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। -সহিহ বোখারি : ২০২৫
নবীপত্নীরাও নিজ নিজ ঘরে ইতিকাফ করতেন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন। -সহিহ বোখারি : ২০২৬
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের মধ্যম দশকে ইতিকাফ করতেন। -সহিহ বোখারি : ২০২৭
ওফাতের বছর মহানবী (সা.) ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, কিন্তু তার ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন। -সহিহ বোখারি : ২০৪৪
এ ছাড়া ইতিকাফ হলো, আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, দুনিয়াবিমুখতা এবং আল্লাহর রহমতে সিক্ত হওয়া ও ক্ষমা চাওয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আর ইতিকাফকারী ব্যক্তির উদাহরণ দিতে গিয়ে আতা (রহ.) বলেন যে কোনো ব্যক্তি এসে কারো দরজায় কড়া নাড়ল এই বলে যে যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে কিছু না দেওয়া হবে, ততক্ষণ সে এখান থেকে এগোবে না। অনুরূপভাবে ইতিকাফকারী ব্যক্তিও আল্লাহর দরজায় কড়া নাড়তে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা অর্জিত না হয়, ততক্ষণ সে আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয়ে ফিরে আসে না। -মারাকিল ফালাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা : ২৬৯
ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাদের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তার পূতঃপবিত্র বিবিগণসহ সাহাবায়ে কিরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর আমৃত্যু আমল করেছেন। -হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৪২
সওয়াবের দিক থেকে ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো- মসজিদে হারাম। এরপর মসজিদে নববি। তারপর মসজিদে আকসা। এরপর যেকোনো জামে মসজিদ। তারপর যেকোনো পাঞ্জেগানা মসজিদ। তবে নারীদের জন্য ইতিকাফের স্থান হলো ঘরের নির্দিষ্ট কোনো পবিত্র স্থান। এ ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি প্রযোজ্য। নারীদের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহে তাহরিমি। কারণ বর্তমান যুগ ফিতনা-ফ্যাসাদের যুগ। মসজিদে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রবল আশঙ্কা এবং অনৈতিকতা, অশ্লীলতারও আশঙ্কা আছে। তাই বর্তমান যুগে নারীদের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরুহে তাহরিমি। -আল মাবসুত লিল সারাখসি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১১৫