পবিত্র রমজান মাস প্রতি বছর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আগমন করে প্রতিটি মুসলমানের ঘরে। সবাই রমজান মাস এলে আলাদা সুখ-প্রশান্তি অনুভব করে। যারা রোজাপালন করে, তারা অন্য সময় নামাজ না পড়লেও রোজা রাখলে তখন নামাজ ঠিকমতো পড়ে। যারা পুরো বছর টুপি মাথায় দেয় না, তারাও রোজা রেখে মাথায় টুপি লাগায়- রমজানের সম্মানে। এক কথায়, রমজান মাসজুড়ে একটা আলাদা আবহ বিরাজ করে রমজান মাসে। সমাজে একটা পরিবর্তন দেখা যায়, রমজান মাসে।
প্রশ্ন হলো, রমজান মাস কেন এলো? কী তার দাবি? আল্লাহ কেন এত সম্মান দিলেন এ মাসকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের ওপর। আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।’ -সুরা বাকারা : ১৮৩
রোজা শুধু আমাদের মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত নয়; বরং এটা পূর্ববর্তীকাল থেকে চলে আসছে। রমজান মাসে ধনীদের মধ্য থেকে যারা রোজা রাখে, তারা অনুভব করে, যারা অসহায়, দুস্থ, এতিম- ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পারে না; তারা যখন ক্ষুধার্ত থাকে কতটুকু কষ্ট পায়। ক্ষুধার জ্বালা রমজান মাসে ধনী রোজাদাররা মর্মে মর্মে অনুভব করে। রোজার শিক্ষা নিয়ে যারা জীবন পরিচালনা করবে, তারা পেটপুরে খাবে, আর প্রতিবেশীরা উপবাস থাকবে, এটা কখনো হয় না। গরিবদের খাদ্যপ্রদানসহ সবক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করাই হলো- মাহে রমজানের অন্যতম শিক্ষা।
রোজা প্রকৃতপক্ষে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ট্রেনিং দেয়। মানুষের মধ্য তিনটি প্রবৃত্তি খুবই জোরালো। সে তিনটি পর্যায়ক্রমে হচ্ছে- ১. খাদ্যগ্রহণের প্রবৃত্তি, ২. যৌন প্রবৃত্তি ও ৩. পরিশ্রমের পর বিশ্রাম গ্রহণের প্রবৃত্তি। এ তিনটি প্রবৃত্তি হচ্ছে- সবচেয়ে শক্তিশালী প্রবৃত্তি। এদের যদি দমন করা যায়, তবে অন্য প্রবৃত্তিগুলো সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ প্রবৃত্তিগুলো দমন করা যায়, রোজার মাধ্যমে।
দিনের বেলা খাদ্যগ্রহণ ও যৌন প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবার রাতে এ দু’টোকে ছেড়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বিশ্রাম প্রবৃত্তিকে। কারণ রাতে তারাবি নামাজ পড়া, যা অন্য মাসে নেই এবং রাতে সাহরি খাওয়া। সেটাও অন্য কোনো সময়ে নেই। এসব হচ্ছে বিশ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ নিয়ন্ত্রণের পেছনে মাত্র একটাই শক্তি কার্যকর থাকে, তা হচ্ছে- আল্লাহতায়ালার প্রতি বিশ্বাসগত ভয়। এই ভয়কে আল্লাহর ভালোবাসা দিয়ে পালন করলে, সেই ইবাদত জীবনে প্রভাব ফেলবে। রোজার ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়।
রমজান মাসে কোরআন মাজিদ নাজিল হয়েছে। কোরআন গোটা মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলিতে পরিপূর্ণ, যা সঠিক ও সত্যপথ প্রদর্শন করে। এটা হক-বাতিলের পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। রমজান থেকে শিক্ষা নিয়ে কোরআনে শিক্ষা মানবজীবনে প্রতিফলন ঘটানো রমজানের অন্যতম লক্ষ্য।
এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে লোক রমজান মাসের রোজা রাখবে ইমান ও চেতনা সহকারে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ -সহিহ বোখারি
কিন্তু এই সুসংবাদ এমনি এমনি আসবে না। আমরা যদি আল্লাহ এবং তার রাসুলের দেখানো পথে চলি, তবে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই আমাদের সহজ-সরল পথে পরিচালিত করবেন, অন্যথায় নয়। রমজান শেষ হয়ে গেলে মসজিদগুলো আবার খালি হয়ে যায়। মানুষের আচার-আচরণ আগের মতো অস্বাভাবিক হতে থাকে। সুদ, ঘুষসহ নানা অশালীন কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু হয়। এ ধরনের কার্যক্রম যদি রমজানের রোজা আমাদের বিরত না রাখতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের রোজা পরিপূর্ণ আদায় হয়নি।
শুধুমাত্র নামাজ, দান-সদকা, নফল ইবাদত, ভালো কাজ, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ- এগুলো রমজান মাসে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরোটা বছর যদি এ কাজগুলো চালু রাখি, তাহলে আমরা রমজান মাসের আলোকে জীবন গড়তে সক্ষম হব।