ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নানাবিধ জুলুম, শারীরিক নির্যাতন, লুটপাট ও চাঁদাবাজীর দায়ে ডিজি বশিরুল আলম, ধর্ম সচিব আব্দুল হামিদ জম্মাদ্দারসহ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার আহবান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জাতীয় শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ।
মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন জাতীয় শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল হক, সহ সভাপতি মো. সাইদুর রহমান ফকির, মো. সুলতান উদ্দিন, মো. ওবায়দুর রহমান ও মো. আব্দুর রহমান আলম।
বক্তারা বলেন, ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে ধর্ম সচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) ডিজি নানাবিধ অপতৎপরতা চালিয়েছেন। চাকরি খাওয়ার হুমকি দিয়ে গণশিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষকদের মাঠে নামতে বাধ্য করেন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যা দিয়ে ৪ আগস্ট রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইসিসির সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এর নেপথ্যে কাজ করেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দার এবং ইফা ডিজি ড. বশিরুল আলম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যানার এবং ফেস্টুন ইংরেজিতে প্রস্তুত করা হয়। ব্যানার, ফেস্টুনের বাংলা-ইংরেজি স্লোগানগুলো লিখে দেন গণশিক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিউল আলম তালুকদার।
মানববন্ধনের অংশগ্রহণকারী শিক্ষক মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, গণশিক্ষার পিডির নির্দেশে আমি মানববন্ধনে অংশ নেই। পিডিকে নাকি ধর্ম সচিব ও ডিজি নির্দেশ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, মানববন্ধনে অংশগ্রহণ না করলে চাকরি থাকবে না।
ভাষানটেক জোনের মডেল কেয়ারটেকার মো. মফিজ উদ্দীন মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানববন্ধনে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। না হলে চাকরি থাকবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়।
মানববন্ধনের অংশগ্রহণকারী ভাষানটেক জোনের শিক্ষক মো. মহসিন তফাদার বলেন, গণশিক্ষা প্রকল্পের পরিচালকের নির্দেশে তারা মানবন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।
জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক মানববন্ধনে অংশ নিতে অন্যদের উৎসাহ দিতে বলে বেড়ান, মানববন্ধন সফল করতে পারলে ধর্ম সচিবের চাকরি এক বছর এক্সটেনশন হবে আর ইফা ডিজি অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব হতে পারবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী নভেম্বর মাসে ধর্মসচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দারের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে। চাকরি ১ বছর মেয়াদ বৃদ্ধি অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য তিনি বিগত সরকারের দালালি করেন।
ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা হলেও বছরের পর বছর নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় চলছে প্রতিষ্ঠানটি। ইসলামি মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও নিম্নতর পদের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসহ একাধিক বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন একাধিক উপ-পরিচালক।
এ ছাড়া বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ফাউন্ডেশনের গাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। আর এসব অনিয়মের সুযোগ করে দিচ্ছেন খোদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. বশিরুল আলম। তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক অনিয়ম, অন্যায়, অত্যাচার আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ডিজির পদত্যাগ দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শেখ হাসিনার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে নানা কর্মসূচি পালন করছে। ৬ ও ৭ আগস্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার কার্যালয় ঘেরাও এবং বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন।
বশিরুল আলম ২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ডিজি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। আওয়ামী প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব পদে একই রকম প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য গত বছর চাকরি চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে সারা দেশের শিক্ষক ও ইমামদেরকে জোরপূর্বক ঢাকার পূর্বাচলের ইমাম সম্মেলনে যোগ দিতে বাধ্য করে। আর এই সম্মেলনে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির গত ৩ বছরের অব্যয়িত অর্থ প্রায় ৬ কোটি টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যয় করে। অথচ এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করার কথা ছিল।
ইফা ডিজি মূল পরিচালকদের প্রধান কার্যালয় থেকে ঢাকার বাইরে বদলি করে দেয়। অন্যান্য পরিচালক পদে তার আশীর্বাদপুষ্ট উপ-পরিচালকদের একাধিক দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়। যাতে তার অনিয়ম করতে সুবিধা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, কথায় কথায় কর্মকর্তাদের শোকজ ও মামলা দায়ের করে, যাতে ভয়ে কেউ কোনো কথা না বলে। কিছুদিন আগে বিলম্বে অগ্রিমের বিল দাখিল করার কারণে ইফা কর্মকর্তা মাওলানা মো. নূর উদ্দীনের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিধি বহির্ভূতভাবে বিভাগীয় মামলা দায়েরপূর্বক তাকে গুরুদণ্ড দিয়ে তার বেতন স্কেল নামিয়ে দেয়। অথচ এই অফিসে অনেক কর্মকর্তার নামে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম রয়েছে, যা এখনও সমন্বয় হয়নি। স্বয়ং তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাসুদের নামে ৬ লাখ টাকা অগ্রিম রয়েছে, যা তিনি এখনো সমন্বয় করেননি।
বিষয়টি নিয়ে খোদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বাতিল করেছেন। এরকম আরও শত অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের অন্যতম সহযোগী হচ্ছে তার আজ্ঞাবহ উপসচিব (সিনিয়র সহকারী সচিব) বায়তুল মোকাররম মসজিদ-মার্কেটের পরিচালক আবু সাঈদ। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। যার বড় একটি অংশ ডিজির পকেটে চলে যায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যে কারণে অভিযোগ উঠলেও ডিজি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সর্বশেষ চাকুরির মেয়াদ বাড়ানো ও সচিব হওয়ার আশায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বানানোর উদ্যোগ নেন তিনি। ম্যুরাল স্থাপনের ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ম্যুরাল বানানো উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইফা ডিজি ড. বশিরুল আলম অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব হওয়ার আশায় এমন কোনো কাজ নাই করেননি। ম্যুরাল বানানোর অপচেষ্টা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে তিনি কলুষিত করেছেন। তার বিচার হওয়ার উচিত।