প্রত্যেকেরই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। এটা এক সেকেন্ডও এদিক-সেদিক হবে না। কখন মৃত্যু আসবে, মানুষ জানে না। মানুষ যেন মৃত্যুকে ভুলেই থাকে। দুনিয়ার আরাম-আয়েশের পেছনে ছুটে চলা দেখলে তো তা-ই মনে হয়। দুনিয়ায় মানুষের যত কর্ম, সবই সেদিন প্রকাশিত হবে। কোনো কিছু সেদিন আর গোপন থাকবে না। আমরা কেন ভুলে যাই- দৃশ্য-অদৃশ্য যা কিছু হয়; সবই আল্লাহপাক দেখেন। মানুষের মনের কথাও আল্লাহপাক জানেন। মানুষ মানুষকে ফাঁকি দিতে পারে; কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। এই চিন্তাটুকু মাথায় থাকা জরুরি।
কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে চাও, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের কাছে পৌঁছবে। অতঃপর তোমরা অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। আর তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন তোমাদের সেসব কর্ম, যা তোমরা দুনিয়াতে করতে।’ -সুরা জুমুআ : ৮
অতএব, প্রত্যেক মানুষ তার অন্তরে ভালো কাজের তাড়না অনুভব করে- সেই সঙ্গে অনুভব করে তার কুপ্রবৃত্তির তাড়নাও। কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখলেই আছে সুসংবাদ।
আলেমরা বলেন, যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে মৃত্যুর স্মরণ অত্যন্ত কার্যকরী আমল। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে, আলেমরা আরও যেসব বিষয়ে চিন্তার কথা বলেন, সেগুলো হলো-
হঠাৎ মৃত্যুর বিষয়টি স্মরণে রাখা
মৃত্যু কাউকে ক্ষমা করে না। মৃত্যর মাধ্য বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটে, স্ত্রীরা বিধবা আর সন্তানরা এতিম হয়ে যায়। সাহাবি হজরত আবু বাকরা (রা.)-এর মৃত্যুশয্যায় সন্তানরা চিকিৎসক নিয়ে আসতে চাইলে তিনি অনুমতি দেননি। মৃত্যুর ফেরেশতা আসার পর তিনি উচ্চস্বরে সন্তানদের বলতে লাগলেন, কোথায় তোমাদের চিকিৎসক? সত্যবাদী হলে মৃত্যুদূত ফেরাও তো দেখি! -আল আলামুল আখির : ২৮
সুতরাং প্রতিটি জীবকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। আর আপনি কি চান, যখন এর মুখোমুখি হবেন, অশ্লীলতার মধ্যে ডুবে থাকবেন? কিংবা মৃত্যু যখন হানা দেবে, তখন নামাজহীন অবস্থায় শুয়ে থাকবেন?
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু আসে, সে বলে, ‘হে আমার রব! আমাকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠান, যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি যা আমি পূর্বে করিনি।’ -সুরা মুমিনুন : ৯৯-১০০
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, জনৈক ব্যক্তি এসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, কোন মুমিন উত্তম? তিনি বললেন, যে সর্বোত্তম চরিত্রবান। লোকটি বলল, কে সর্বাধিক জ্ঞানী? তিনি বললেন, মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণকারী এবং তার পরবর্তী জীবনের জন্য সর্বাঙ্গীন সুন্দর প্রস্তুতি গ্রহণকারী। তারাই হলো প্রকৃত জ্ঞানী। -ইবনে মাজাহ : ৪২৫৯
মরদেহ গোসলের কথা মনে করুন
যখন লোকেরা গোসলের জন্য আপনার মরদেহটি খাটিয়ায় রাখবে, তখন আপনি নিশ্চল-নিশ্চুপ ও নিথর মৃতদেহ বৈ কিছু নয়। আপনি নড়তে পারবেন না, তারা আপনাকে নাড়াবে। তখন আপনার গুনাহগুলো আপনার কোনো উপকারে আসবে কি?
স্মরণ করুন, আপনার জানাজা মানুষ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন, আপনার জানাজা মানুষ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। তখন কোথায় থাকবে আপনার শক্তি? আপনার যৌবন, আপনার অহমিকা ও আপনার বন্ধুরাই বা তখন কোথায় থাকবে? সেদিন যে নেক আমলগুলো আপনি করেছিলেন, সেগুলো ছাড়া আর কোনো কিছুই উপকারে আসবে না।
হজরত উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) জনৈক আলেমকে বলেন, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আপনিই প্রথম খলিফা নন, যিনি মৃত্যুবরণ করবেন। খলিফা বললেন, আরও উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আদম পর্যন্ত আপনার বাপ-দাদাদের এমন কেউ ছিলেন না যিনি মৃত্যুবরণ করেননি। এবার আপনার পালা। একথা শুনে খলিফা কেঁদে ফেলেন। তিনি প্রতি রাতে আলেমদের নিয়ে বৈঠক করতেন। যেখানে মৃত্যু, কেয়ামত ও আখেরাত নিয়ে আলোচনা হতো। তখন তারা এমনভাবে কাঁদতেন, যেন তাদের সামনেই জানাজা উপস্থিত হয়েছে। -ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন : ৭/১৩৯
ভাবুন, আপনাকেও কবরে রাখা হবে
যখন আপনাকে কবরে রাখা হবে, সেদিন আপনার কোনো প্রিয়জন সঙ্গে যাবে না। আপনার বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের লোজজন আপনাকে কবরে রেখে চলে আসবে। হ্যাঁ, সেদিন আপনার সঙ্গে আপনার কবরে ঢুকবে কেবলই আপনার আমল। ভেবে দেখুন, কোন আমলগুলো আপনি নিজের সঙ্গে কবরে নামানোর জন্য প্রস্তুত করছেন? ফেসবুকিং, ইউটিউবিং, গেমিং, গ্যাম্বলিং না এর চেয়েও জঘন্য কোনো কিছু?
কবি বলেন, হে মানুষ! সত্বর তুমি দাফন হবে মাটিতে। ইহকালে আমরা আমাদের জীবনের অল্পসময়ই কাটিয়ে থাকি। আর আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল হলো- মাটির ঘরে (কবরে)।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তুমি নিজেকে কবরবাসীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করো। -জামে তিরমিজি : ২৩৩৩
মাঝে মাঝে কবর জেয়ারত করুন
উপরোক্ত বিষয়গুলো স্মরণে জিইয়ে রাখার জন্য মাঝে-মধ্যে কবর জেয়ারত করুন। এর দ্বারা অন্তর নরম হবে। গুনাহের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কবর জিয়ারত অন্তরকে নরম করে, চোখের পানি বের করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ -মুসতাদরাক হাকিম : ১৫৩২
হজরত উসমান (রা.) কবরস্থানে গিয়ে কাঁদতেন। যাতে দাড়ি ভিজে যেত। তাকে বলা হলো- জান্নাত-জাহান্নামের কথা শুনে আপনি কাঁদেন না, অথচ কবরে এসে কাঁদেন? জবাবে তিনি বলেন, কবর হলো- আখেরাতের প্রথম মনজিল। যদি কেউ এখানে মুক্তি পায়, তাহলে পরের মনজিলগুলো তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর এখানে মুক্তি না পেলে পরের মনজিলগুলো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। -জামে তিরমিজি : ২৩০৮